ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফাইনালে অবিশ্বাস্য জয় মোহমেডানের

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:১৩, ৩১ মে ২০২৩

ফাইনালে অবিশ্বাস্য জয় মোহমেডানের

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা

‘বেশি বলা হচ্ছে কি না জানি না, মনে হচ্ছে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখছি। আবাহনী-মোহামেডান তো বটেই, বাংলাদেশের ফুটবলে সেরা একটা ম্যাচ। টাইব্রেকারে যারাই জিতুক, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি উপভোগ্য একটা ম্যাচ ছিল।’ ফেসবুকে বাংলাদেশী এক ফুটবলপ্রেমীর এমনই মন্তব্যে সহজেই বোঝা যায় মঙ্গলবার কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ৩৩তম আসরের ফাইনালটা কেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, রোমাঞ্চকর, উপভোগ্য এবং শ্বাসরুদ্ধকর হয়েছিল, যাতে অংশ নিয়েছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা আবাহনী লিমিটেড এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ‘ক্লাসিক’ এই ফাইনাল শেষে আবাহনীকে টাইব্রেকারে ৪-২ (৪-৪) হারিয়ে শিরোপাজয়ের বাঁধনহারা উল্লাসে মেতেছে ‘ব্ল্যাক এ্যান্ড হোয়াইট’ খ্যাত মোহমেডান। চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ফুটবলার ও কোচিং স্টাফদের জন্য ৪০ লাখ টাকা বোনাস দিয়েছেন মোহামেডানের অন্যতম পরিচালক ও ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর।  
টাইব্রেকারে মোহামেডানের হয়ে সুলেমান দিয়াবাতে, আলমগীর কবির রানা, রজার ও কামরুল ইসলাম গোল করেন। শাহরিয়ার ইমন মিস করেন। পক্ষান্তরে টাইব্রেকারে আবাহনীর রাফায়েল অগাস্তোর শট বদলি গোলরক্ষক আহসান হাবিব বিপু ডান দিকে ঝাঁপিয়ে রুখে দেন। এমেকা ও ইউসেফ মোহাম্মদ গোল করলেও ড্যানিয়েল কলিনড্রেসের শট রুখে দিয়ে বিপুই হন জয়ের অন্যতম নায়ক। আবাহনীকে হারিয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপের শিরোপা জিতল মোহামেডান। এটা তাদের একাদশ শিরোপা।

পক্ষান্তরে এ নিয়ে অষ্টমবার ফাইনালে হারলো ‘দ্য স্কাই ব্লু ব্রিগেড’ খ্যাত আবাহনী (যদিও তারা রেকর্ড ১২ বারের চ্যাম্পিয়ন)। মজার ব্যপার-১৪ বছর আগে ২০০৯ সালের ফাইনালেও মোহামেডান টাইব্রেকারের আশ্রয় নিয়েই আবাহনীকে হারিয়েছিল ৪-১ (০-০)! 
মঙ্গলবারের ফাইনালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল মোহামেডানের অধিনায়ক-ফরোয়ার্ড সুলেমান দিয়াবাতের হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোল। ফেডারেশন কাপের ফাইনালে কোন ফুটবলার চারটি গোলের কৃত্তিত্ব নেই। ৪৩ বছরের এই টুর্নামেন্টে বিরল রেকর্ড গড়লেন এই মালির ফুটবলার। অনেকেই বলছেন, দিয়াবাতে যেন কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের সেই কিলিয়ান এমবাপ্পে, যিনি হ্যাটট্রিকসহ টাইব্রেকারে মোট ৪টি গোল করেছিলেন। তবে পার্থক্য হলো এমবাপ্পের সেই অতিমানবীয় নৈপুণ্যের পরও মেসির আর্জেন্টিনার কাছে হারতে হয়েছিল ফ্রান্সকে, কিন্তু দিয়াবাতের অতিমানবীয় নৈপুণ্যে জিতেছে মোহামেডান।
আবাহনীর দুর্ভাগ্য, ম্যাচে তারা দু’বার লিড নিয়েও সেটা আর ধরে রাখতে পারেনি। বরং অতিরিক্ত সময়ে পিছিয়ে পড়ে বরং হারের শঙ্কায় ছিল তারা। বাফুফের কাছে মোহামেডানের সমর্থকদের দাবি ছিল যেন বিদেশী রেফারি থাকে। কিন্তু বাফুফে সেটা মানেনি। কিন্তু দেশী রেফারির নিরপেক্ষ রেফারিং ছিল প্রশংসিত। গ্যালারিতে সমর্থনেও এগিয়ে ছিল মোহামেডান! কেননা কুমিল্লা হচ্ছে প্রয়াত বাদল রায়ের জন্মস্থান, যিনি মোহামেডানের কিংবদন্তি ফুটবলার ছিলেন। ফাইনাল হয়েছে ফাইনালের মতোই। যারা আবাহনীর সমর্থক, তারাও বলছেন এই হারে লজ্জা-গ্লানি-কষ্ট নেই। কেননা যোগ্য দল হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মোহামেডান। তাছাড়া দেশের ফুটবলের ক্রান্তিলগ্নে মোহামেডানের দীর্ঘ নয় বছরের (২০১৪ সালে স্বাধীনতা কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়াই ছিল মোহামেডানের সর্বশেষ কোন শিরোপাজয়) এই শিরোপাজয়ের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। যা দেশের ফুটবলের জন্যই মঙ্গলজনক। 
দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর এই ফাইনাল আরেকটি কারণেও তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা এই প্রথম ঢাকার বাইরে ফাইনালে মুখোমুখি হলো। ম্যাচের আগে মোহামেডানের টিম মিটিংয়ে কোচ আলফাজ আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমাদের হারানোর কিছু নেই। বসুন্ধরা কিংসকে হারিয়ে আমরা অনেকটা চ্যাম্পিয়ন হয়েই গেছি। তাই চাপ নেয়ার দরকার নেই। যার যার স্বাভাবিক খেলাটা খেলবে।’ আলফাজের সেই কথাকেই মাঠে প্রতিফলন ঘটান তার শিষ্যরা।

১৫ মিনিটে এমেকার ডিফেন্স চেরা ক্রস পান ফয়সাল আহমেদ ফাহিম। তার নিচু শট গোলরক্ষক সুজনের পায়ে লেগে জালে জড়ায়। লিড নেয় আবাহনী (১-০)। ৪৩ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কলিনড্রেস। মাঝমাঠ থেকে লম্বা করে বল বাড়ান হৃদয়। বক্সের ভেতর বল পান ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলা কোস্টারিকান কলিনড্রেস। তীব্র শটে দূরের পোস্টে বল জালে জড়ায় (২-০)। এরপরই ডিফেন্সিফ ন্টাইলে খেলতে থাকে আবাহনী। এটারই সুযোগ নেয় মোহামেডান। একের পর এক আক্রমণ শাণায়।  মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে জোড়া গোলে মোহামেডানকে সমতায় ফেরান দিয়াবাতে।

৫৬ মিনিটে বক্স বরাবর কামরুল ইসলামের শটে বল বিপদমুক্ত করতে ব্যর্থ হন রহমত মিয়া। ফাঁকায় বল পান দিয়াবাতে। তার প্লেসিং শট আবাহনী গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেলকে ফাঁকি দিয়ে জড়ায় জালে (১-২)। ৬০ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে মুজাফফরভের শট ফিস্ট করে ফেরান গোলরক্ষক সোহেল। তার ফিস্টে বক্সের বাঁপ্রান্তে বল পান জাফর ইকবাল। জাফরের শট থেকে লাফিয়ে হেডে বল জালে জড়ান দিয়াবাতে (২-২)। ৬৬ মিনিটে ফাহিমের শট ঝাঁপিয়ে ফিস্ট করেছিলেন মোহামেডান গোলরক্ষক সুজন হোসেন। তার সামনেই ফাঁকায় থাকা ওগবাহ দেরি না করে বল জালে পাঠান (৩-২)। ৮৩ মিনিটে কামরুল ইসলামের কর্নার থেকে দিয়াবাতের হেড আবারও সমতায় ফেরায় মোহামেডানকে (৩-৩)। 
নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০৫ মিনিটে পেনাল্টি পায় মোহামেডান। স্পটকিক থেকে দলকে এগিয়ে দেন দিয়াবাতে (৪-৩)। মোহামেডান যখন নিশ্চিত জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ম্যাচে নাটকীয় মোড়। ১১৮ মিনিটে রহমতের গোলে সমতায় ফেরে আবাহনী (৪-৪)। বক্সের বাইরে থেকে রহমতের শট ঝাঁপিয়ে পরেও ঠেকাতে পারেননি বদলি গোলরক্ষক বিপু। শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। আর সেখানে কি হয়, তা তো পাঠকরা জেনে গেছেন আগেই। 
পুরস্কারসমূহ ॥ ম্যান অব দ্য ফাইনাল : সুলেমান দিয়াবাতে (মোহামেডান), সর্বোচ্চ গোলদাতা : সুলেমান দিয়াবাতে (৮ গোল, মোহামেডান), প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট : সুলেমান দিয়াবাতে (মোহামেডান), ফেয়ার প্লে ট্রফি : বসুন্ধরা কিংস, রানার্সআপ : ঢাকা আবাহনী লিমিটেড (মেডেল, ট্রফি ও ৩ লাখ টাকা), চ্যাম্পিয়ন : মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব (মেডেল, ট্রফি ও ৫ লাখ টাকা।

×