ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের সোহাগী ও স্বপ্না এখন ঠাকুরগাঁওয়ের গর্ব

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২

সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের সোহাগী ও স্বপ্না এখন ঠাকুরগাঁওয়ের গর্ব

সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের দুই ফুটবলার স্বপ্না ও সোহাগী

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী জাতীয় নারী ফুটবল দলের দুই সদস্য সোহাগী কিসকু ও স্বপ্না রানী ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বাসিন্দা। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় জেলাজুড়ে আনন্দের বন্যা বইছে। খেলা শেষ হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। সেই স্বপ্না আর সোহাগীকে নিয়ে গর্বিত ঠাকুরগাঁও জেলাবাসী বিশেষ করে রানীশংকৈলবাসী। বিজয়ী নারী ফুটবল দলের সদস্যদের দেশের মাটিতে পা রাখা এবং তাদের উন্মুক্ত বাসের ছাদে নিয়ে শহর প্রদক্ষিণের দৃশ্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখার জন্য এলাকায় ছিল ভিড় আর আনন্দ মিছিল। এ সময় আনন্দ উল্লাসে আবেগাপ্লুত হয়ে আনন্দে অনেকে কেঁদে ফেলেন।  
এই তো সেদিনের কথা। যে গ্রামবাসী সবসময় বলত মেয়েরা ফুটবল খেলবে এ নিয়ে কত কথা, কত কটূক্তি! সেসব উপেক্ষা করে খেলা চালিয়ে গেছেন সোহাগী কিসকু আর স্বপ্না রানীরা। এখন তারা বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের নিয়মিত মুখ। নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের দুই খেলোয়াড় সোহাগী কিসকু আর স্বপ্না রানীর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলায়।

সেখানে তাদের পরিববারের সদস্যদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। কথায় উঠে আসে সোহাগী-স্বপ্নাদের ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য সোহাগী কিসকু। বাবা গুলজার কিসকু পেশায় কৃষিশ্রমিক। সোহাগীরা তিন বোন, দুই ভাই। বড় বোন ইপিনা কিসকুর বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি চার ভাইবোনই ফুটবল খেলে। ছোট বোন কোহাতি কিসকু অনুর্ধ ১৯ জাতীয় নারী দলের খেলোয়াড়।
জাতীয় নারী দলের সদস্য সোহাগীর ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে গুলজার কিসকু বলেন, ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি সোহাগীর টান ছিল। প্রাইমারি স্কুলে থাকা অবস্থায় বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট দিয়ে ফুটবল খেলা শুরু তার। এরপর যখন রানীশংকৈল ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি করে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন, তখন সোহাগী সেখানে যোগ দেন। এটা দেখে ‘মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে মাঠে খেলে’, ‘লজ্জা-শরম নেই’, ‘এদের কখনও বিয়ে হবে না’- এমন সব কটূক্তি করতেন গ্রামের অনেকে।

রেগে গিয়ে তিনি মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতেন। তবে যখনই সুযোগ পেতেন, মাঠে চলে যেতেন সোহাগী। নিয়মিত অনুশীলনে অনুর্ধ-১৪ ঠাকুরগাঁও জেলা দলে জায়গা করে নেন সোহাগী। ২০১৭ সালে ঠাকুরগাঁও জেলা ফুটবল দল বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়। সেবার সোহাগী অসাধারণ পারফর্ম করেন। তখনই সোহাগী বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) এক কর্মকর্তার নজরে পড়েন। তিনি নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকে সোহাগীর ব্যাপারে জানান। তিনি তাজুল ইসলামকে ফোন করে সোহাগীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে বলেন। এরপর সোহাগী অনুর্ধ-১৫, অনুর্ধ-১৭ ও অনুর্ধ-১৮ পেরিয়ে এখন জাতীয় দলে।
সোহাগীর বাবা জানান, মেয়ের খেলা পরিবারের সবাই মিলে দেখেন। গত সোমবারে বাংলাদেশ ও নেপালের ফাইনাল খেলাটিও দেখেছেন। সোহাগী কিসকুর বোন ইপিনা কিসকো বলেন, বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল ফাইনালে জয়ী হয়েছে। এই দলে আমার বোন রয়েছে। আমরা সবাই খুশি আর সেই সাঙ্গে ঠাকুরগাঁও জেলাবাসী তাদের জন্য আজ গর্ববোধ করছে।
পাশের বনগাঁও শিয়ালডাঙ্গী গ্রামে স্বপ্নাদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, স্বপ্নার মা সাবিলা রানী রান্নার কাজে ব্যস্ত। স্বপ্নার কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘ফুটবল খেলতে গিয়ে মেয়েটা কতই না কষ্ট করেছে। মেয়েটার জন্য এখন ভাল লাগছে।’
স্বপ্নার বাবা নীরেন হৃদরোগে ভুগছেন। খুব একটা কাজ করতে পারেন না। স্বপ্নার বড় বোন কৃষ্ণা রানীর সেলাইয়ের আয়ে সংসার চলে। আরেক ভাই ও বোন লেখাপড়া করছে। তার বাবা জানান, স্বপ্না ২০১৬ সালের দিকে স্থানীয় নারী ফুটবল দলে সুযোগ পান। সেখান থেকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। সেখান থেকে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলার পর ২০১৯ সালে জাতীয় নারী ফুটবল দলে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলা শুরু করেন। স্বপ্নার বাবা বলেন, ‘আমার বাড়ি রানীশংকৈল শুনলে অনেকেই বলেন, ফুটবল খেলে স্বপ্নাকে চেনেন? তাদের যখন বলি, আমিই স্বপ্নার বাবা, তখন তারা আমাকে খুব সম্মান করেন। মেয়ের জন্য গর্বে বুকটা ভরে যায়। তবে মেয়ে ফাইনালে খেলার সুযোগ পেলে আরও ভাল লাগত।’
স্বপ্নার মা স্বামীর কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘মেয়ে খেলেনি, তাতে কী হয়েছে?
আমরা তো জিতেছি। যে মেয়েরা আমাদের জন্য এত সম্মান এনে দিল, সেই দলে আমার মেয়েও আছে, ভাবতেই ভাল লাগছে।’ তার কথা শেষ হতে না হতেই মুঠোফোনটি বেজে ওঠে। নেপাল থেকে স্বপ্না কল করেছেন। স্বপ্না তখন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল, আমরা যেন চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে ফিরি। আমরা সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছি।’

×