ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-সংস্কৃতি’

গভীর অধ্যয়ন ও উপলব্ধি

মীম মিজান

প্রকাশিত: ০১:০৩, ২১ এপ্রিল ২০২৩

গভীর অধ্যয়ন ও উপলব্ধি

আহমদ রফিক

অধ্যয়ন ও উপলব্ধি সমগোত্রীয় দুটো শব্দ। কেননা, একজন মানুষ যখন অধ্যয়ন করেন তখন তার মধ্যে এক ধরনের বোধ তৈরি হয়। এই বোধের আরেক নাম উপলব্ধি। যার যত বেশি অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ তার তত বেশি উপলব্ধি তৈরি হয়। আর যার মধ্যে এ দুটো সদগুণ বিদ্যমান, তিনি হবেন সমাজের এক অমূল্য সম্পদ ও দিকনির্দেশক। এমনই সদগুণে গুণান্বিত মানুষ হচ্ছেন আহমদ রফিক (জন্ম ১৯২৯)। জ্ঞানচর্চায় যেমন তিনি বটবৃক্ষ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও তেমনি অগ্রণী। চিন্তক, রাজনীতিক ও মানবতাবাদী মানুষ। তাঁর সৃজনসম্ভার আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও সময়োপযোগী। বাংলাদেশের সাম্যবাদী চিন্তার অন্যতম বাতিঘর তবে, সে সাম্যবাদী চিন্তা অন্য আট-দশজনের মতো নয়। তাত্ত্বিক নানা উপাদানের সাথে সামসাময়িক বিশ্বের পরিস্থিতি উপলব্ধি করে নিজের সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটান ও তার বাস্তবায়ন কামনা করেন। 
সাম্যবাদিতা বা শান্তিবাদিতা বিশ্বের প্রায় সব সৃজনশীল মানুষের কামনা। তাঁরা মানুষের ভেদাভেদ তুলে দিতে চান। প্রতিষ্ঠা করতে চান সুস্থির নিখিল। তাহলে তাঁরা অবশ্যই মানবতাবাদী। এমনই মানবতাবাদী ও শান্তিবাদী কবি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। অধ্যাত্মবাদ তাঁকে আলোড়িত করত। নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে সমর্পিত কবিতা ও গীতই তাঁকে এনে দিয়েছিল সাহিত্যের সর্বোচ্চ খ্যাতি নোবেল। এমনই মানবতাবাদী, শান্তিবাদী ও অধ্যাত্মবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন, আত্মস্থ করেছেন, নিজের ভিতর ধারণ করেছেন, হয়েছেন রবীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ, তিনিই প্রাগুক্ত আহমদ রফিক।
মানুষ, মানবতা, প্রিয়জন ও স্রষ্টাকে কঠিনভাবে উপলব্ধির সময় অতিমারি করোনাকালে (গত বছরের অক্টোবরে) প্রকাশিত হয়েছে আহমদ রফিকের রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে অধ্যয়ন ও উপলব্ধির মননশীল গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-সংস্কৃতি।
পরস্পর সম্পর্কযুক্ত আঠারোটি প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে চিন্তা রাজ্যে সাড়া ফেলানো গ্রন্থটি বর্তমান অস্থিরতার বিশ্বে এক সুস্থিরতার আহ্বানের নামফলক। নিপীড়িতদের উদ্ধারের মোক্ষম মন্ত্র। অজ্ঞতা, জড়তাকে ছুঁড়ে ফেলার উত্তম নেয়ামক। এতসব ইতিবাচকতা ও গ্রহণীয় উপাদান যে গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে, ফুটে উঠেছে মানুষের মুক্তির কামনা, তা কিন্তু ঐ চিন্তার নায়ক রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই। কেননা, বহুমাত্রিক লেখক রবীন্দ্রনাথকে সূক্ষ্মভাবে পড়েছেন। তাঁকে নিয়ে ভেবেছেন। তাঁর চিন্তার সাথে পূর্বাপর অনেক বিষয়ের তুলনামূলক অধ্যয়ন করেছেন। ফলে রবীন্দ্র চিন্তা ও কর্ম থেকে মানুষের জন্য উপকারী সারবস্তু থেকে নিয়ে তা তুলে ধরেছেন বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে।

প্রথম যে নিবন্ধটি এ গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে সেটি হচ্ছে, ‘পদ্মা-বাংলায় ভিন্নমাত্রিক উপলব্ধি ও সৃষ্টিকর্মের রবীন্দ্রনাথ’। শিরোনাম দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে রবীন্দ্রনাথের উন্মেষপর্ব আলোচিত হতে যাচ্ছে। নাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জমিদারিত্ব দেখভালের কাজ কলকাতার নগর থেকে বাংলার শ্যামলিমা নদী বিধৌত পল্লীতে নিয়ে আসে। আর পদ্মা, ইছামতী, বড়াল, আত্রাই, গড়াই বা নাগর নদী তাঁকে দিয়েছিল স্রোতের মতোই সৃজনের গতি ও উপাদান। তাঁর ছোটোগাল্পিক জীবনের উন্মেষই এ নদী বিধৌত পল্লীগাঁয়ে। আবার ‘সোনার তরী’সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবিতায়ই এখানে লিখেন। গীতাঞ্জলির অনুবাদও এখান থেকেই আরম্ভ করেন।

শিলাইদহ আর শাহজাদপুরের প্রকৃতি তাকে অবিরাম লিখতে বাধ্য করতো। দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে কিংবা ঝোড়ো আবহাওয়া নব নব উপলব্ধি দিতো তাঁকে। এখান থেকেই যে তিনি প্রকৃত গল্পকার ও কবি হিসেবে জন্মেছেন, তাই আহমদ রফিক ১৬ পৃষ্ঠার নিবন্ধটিতে যুক্তি ও উদাহরণসহ বর্ণনা করেছেন। এ নিবন্ধ পড়লে মনে হয় যেন লেখকের বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথ পড়তেছি। 
দ্বিতীয় নিবন্ধটি হচ্ছে ‘বিশ্বশান্তি ও মানবিক বিশ্বের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই শান্তিবাদী কবি ও মানুষ।
জীবনে তিনি গোটা বিশ্বে নানাভাবে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনেছেন। দেখেছেন অসংখ্য মানবসন্তানের মৃত্যু। সবকিছুর মূলেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা স্বার্থ। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের কড়া সমালোচক এবং তাকে ‘দানবের যুগ’ বা এজ অব জায়ান্ট বলে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃত আজ এশিয়া ও আফ্রিকার জন্য ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি জোট দানব। আহমদ রফিক রবীন্দ্রনাথের চিন্তা রাজ্যে অবগাহন করে উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতই ‘শান্তির প্রবক্তা’। তিনি শেষ বয়সে এসে বিশ্বনাগরিক চিন্তায় উন্নীত হয়েছিলেন।
নিবন্ধকার যে একজন গভীর পাঠাভ্যাসের অধিকারী তা তাঁর তৃতীয় প্রবন্ধটি পাঠে স্পষ্ট। নোবেল নিয়ে কত পানি ঘোলা করেছে স্বয়ং পশ্চিমা বিশ্ব, আবার কতজন স্ববিরোধী আচরণ ও করেছে, তা খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরেছেন তৎকালীন রথী-মহারথীদের করা গীতাঞ্জলি নিয়ে নানা বিষয়ে এবং গীতাঞ্জলিতে কী কী আছে, নান্দনিক শব্দের ব্যবহার, অলংকার ইত্যাদি আলোচনা শেষে রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিষয়ক তথ্য উপস্থাপন করেছেন। লিখেছেন অনুবাদের কারণ। নিবন্ধটি আমাদের পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতা, রবীন্দ্রনাথের বৈশ্বিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের দলিল। শেষে একটি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন গবেষকদের যে, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্ম নিয়ে আরো কাজ হওয়া উচিত।
চতুর্থ নিবন্ধটি হচ্ছে তৃতীয়টির ধারাবাহিক বিষয়ের উপর। নোবেল পাওয়া নিয়ে যে নাটকীয়তা ও জটিলতা তা চমৎকারভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যসহ তুলে ধরেছেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন রাজনীতি সচেতন কবি ও লেখক, তাঁর উপরে গবেষণা করে যিনি ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি পেয়েছেন তিনিও রাজনীতিক এবং সচেতন মানুষ। তাঁর মানসকে পীড়া দেয় নিপীড়িত মানুষ। বোমার শব্দ তাঁকে ঘুমোতে দেয় না। তাই প্রিয় রবীন্দ্রনাথের জীবনী ও কর্মে সন্ত্রাসবিরোধী মানসিকতা ও কর্ম খুঁজে তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পঞ্চম নিবন্ধটিতে মানুষের জন্য কল্যাণকামিতার কথা পরিস্ফূটিত হয়েছে।
কী চমৎকার কথা! ‘মানব ও মৈত্রীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীর আত্ম বিক্রয় অবিশ্বাস্য ঠেকে’। কিন্তু তা নিদারুণ সত্য। মুখোশধারী আর ভ-ে ছেয়ে গেছে বুদ্ধিজীবী অঙ্গন। শতভাগ উচ্ছিষ্টভোগী। এরকম কটাক্ষ করেছেন যে নিবন্ধে তার শিরোনাম হচ্ছে ‘লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে’। রবীন্দ্রনাথ যে সত্যই একজন দূরদর্শী দার্শনিক তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ নিবন্ধটি।
ষষ্ঠ নিবন্ধটি পাঠ শেষে আমাদের মন্তব্য এমন হবে যে, ‘গুণী স্বর্ণকারের হাতে খাঁটি সোনা যেমন অনিন্দ্য গহনায় রূপ নিয়ে মানুষের দৃষ্টি-মনকে পুলকিত করে, ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথের মতো শুভ চিন্তার মানুষকে গুণী গবেষক আহমদ রফিক চিনেছেন ও সেভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন।’
সপ্তম নিবন্ধটি হচ্ছে ‘মানবধর্ম ও মানবহিতে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ’। এটা সন্দেহাতীত যে, মানবহিতে বিশ্বাসী  ছিলেন প্রায় গোটা জীবন। জীবনের শেষদিকে এসে অর্থাৎ রাশিয়া ভ্রমণের (১৯৩০) পর তিনি মানবধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সেই সাথে বিলেতে থাকাকালীন যুবক রবীন্দ্রনাথের মনে যে প্রগতিশীলতা ও নারীবিষয়ক চিন্তার প্রভাব ছিল, বাধ্য হয়ে স্বগৃহে ফেরার পর পারিবারিক গোঁড়ামির কারণে তা মিইয়ে যায়। এমন আলোচনার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকে একজন মানবধর্মী মানুষ হিসেবে প্রমাণ করেছেন আহমদ রফিক।
গ্রন্থকার প্রগতিবাদী চিন্তার চিন্তক। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথের সৃজন ও কর্মের নানা বিষয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণের সময় সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে খুঁজেছেন প্রগতিবাদী বিষয়বস্তু। অষ্টম নিবন্ধে রবীন্দ্র জীবনের শেষ দশকে (১৯৩০ থেকে ১৯৪১) সূক্ষ্মভাবে খুঁজেছেন প্রগতিশীলতার উপাদান। এবং তা উপস্থাপন করে রবীন্দ্রনাথকে শেষ জীবনে প্রগতিবাদী প্রমাণ করেছেন।
একজন দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ আজকের ইউরোপীয় আগ্রাসন তখনই বুঝেছিলেন। যা আমরা পূর্বেই ‘দানবের যুগ’ হিসেবে উল্লেখিত হতে দেখেছি। তবে রবীন্দ্রনাথের সময়কার আগ্রাসন আর বর্তমান আগ্রাসনের যেরূপ তা এক নয়। চীন ভ্রমণ ও প্রবন্ধ পাঠের আমন্ত্রণে কবি সঙ্গী-সাথীসহ সেখানে পৌঁছে ইউরোপীয় চিন্তা-চেতনাকে কটাক্ষ করে প্রবন্ধ উপস্থাপন করলে, বিজ্ঞান-মনস্ক চীনা তরুণ সমাজ ক্ষিপ্ত হন। আর নানাভাবে রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথকে ঠেকিয়ে দিতে উদ্যত হন। তাই তারা পোস্টার, হ্যান্ডবিল বিলি করেন এবং রবীন্দ্রনাথকে ‘বিতর্কিত অতিথি’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ভ্রমণটির সামগ্রিক বিষয় নিয়েই এ নিবন্ধটি।  

নিবন্ধটিতে গ্রন্থকার নিজের চিন্তা ফলন করেছেন। বিশেষ করে কয়েক জায়গায় রবীন্দ্রনাথের ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে বের করেছেন। যেমনটি প্রগতিবাদী লোকজন ও সে বিষয়ে চিন্তাশীল সমাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার বিষয়টিকে বিচ্যুতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সে সময় জোর আমন্ত্রণ পেয়েও রবীন্দ্রনাথ সানইয়াৎ সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।
রবীন্দ্রনাথের দ্বিচারিতা বা তাঁর চৈতন্যের ভিতরে যে দুটো বিপরীত স্রোত কাজ করত তা নিয়ে আলোচ্য নিবন্ধের শিরোনামটি হচ্ছে, ‘চৈতন্যের দুই বিপরীত স্রোতে রবীন্দ্রনাথ’। পূর্বের নিবন্ধের সাথে বিষয়গত মিলের নিবন্ধটিতে কবির ভিতরে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব আবার সেখানেই নানা ধর্মীয় বিষয়াবলী পালন করেছে, তাঁকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। কবি নিজেই প্রত্যেক দিন প্রার্থনা করতেন। তা তো তাঁর নিজের কাজেরই স্ববিরোধিতা। গ্রন্থকারের ভাষায় সে দুই বিপরীতে চৈতন্য হচ্ছে, ‘একইসঙ্গে উগ্র জাতিপ্রেমের আগ্রাসী চরিত্রের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। আবার একই সময় শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুনে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রবর্তন।’
লেখক বরাবরই নিজ জানালা দিয়ে অর্থাৎ প্রগতিশীলতার দৃষ্টি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্লেষণ করেছেন। অধ্যাতœবাদী বা ভক্তিবাদী কবিতার মাধ্যমেই কিন্তু নোবেল লাভ কবির এবং বাংলা সাহিত্যের। তাই এ বিশ্লেষণ সর্ব-সাধারণের নিকট হয়তো ততটা আবেদন রাখবে না। তবে এ নিবন্ধে যে বিশ্লেষণ করেছেন গ্রন্থকার, তা পাঠকের কাছে তথ্য উপাত্ত ইত্যাদির উপস্থাপন ও মতামত প্রদানের জন্য অনন্য।
একাদশতম নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে নানা পার্থক্য দেখিয়েছেন আহমদ রফিক। কবির রচনা থেকে যখন, ‘পাশ্চাত্যের এই ভেদাভেদতন্ত্রের মূলে রহিয়াছে অন্যজাতির প্রতি অপরিসীম ঘৃণা। জন্মগত স্বাধিকারের নামে অসীম গর্বভরে অন্যজাতিকে ঘৃণা করার পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।’ উদ্ধৃতি করেন তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে কবি ইউরোপ সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করতেন। গ্রন্থকার এখানে বর্তমান বিশ্বের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের উপায়ও স্পষ্ট করেছেন।
যদিও কবি নিজে একজন জমিদার ছিলেন তবুও তাঁর দাবি ছিল আধিপত্যবাদীরা তাদের ক্রীড়নক বন্ধ করুক। তিনি সাধারণ মানুষের জন্য মমতা রাখতেন। চাইতেন সমতা। এমনই বিষয়বস্তু নিয়ে দ্বাদশ নিবন্ধটি।
ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ নিবন্ধে গ্রন্থকার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ও তার আগের রবীন্দ্রচর্চার এক স্বচ্ছ অবস্থা চিহ্নিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ রক্তমাংশে গড়া একজন মানুষ সে হিসেবে তাঁর জৈবিক চাহিদা, ভালোলাগা, ভালোবাসা, রাগ-অনুরাগ থাকতেই পারে। তা দোষের কিছু  নয়। কিন্তু যখনই তিনি বিশ্বখ্যাত কবি তখনই তাঁর নানা বিষয়ে পাঠকমহলে চরম কৌতূহল আর এসব কৌতূহলে বাতাস লাগায় অনেক গুজব। যার বেশিরভাগই কবির জন্য অবমাননাকর। তদুপরি তাঁর জীবনে আগত নারী ও প্রেম নিয়ে খুঁটিনাটি বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা হচ্ছে পঞ্চদশ নিবন্ধটি। নিবন্ধকার এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা না করলেও পারতেন। তা হচ্ছে প্রেম বা নারীঘটিত বিষয়ের উদাহরণ দিতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৫) কথা বলার পাশাপাশি নজরুলের (১৯৮৮-১৯৭৬) বিষয়ে এমন মন্তব্য করা, ‘তবে নজরুলের সৌভাগ্য, তিনি এখনো এমন অনাচারের বড়ো একটা বিষয় হয়ে ওঠেননি, অথচ সুযোগ কম ছিল না।’

প্রেমের পরই রবীন্দ্রনাথের দাম্পত্য জীবন নিয়ে নিবন্ধটি রবীন্দ্র প্রেমীদের জন্য আকর্ষণের অন্যতম উৎস। কিভাবে এত পড়লেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে! বিস্মিত হতে হয়! যাহোক, নিবন্ধকার কবির মাত্র ১৯ বছরের স্বল্পস্থায়ী দাম্পত্য জীবনের পরতে পরতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি উল্লেখ করেছেন। দুঃখের বিষয় এ বটবৃক্ষ কবি তাঁর স্ত্রী বিয়োগের পর দীর্ঘ ঊনচল্লিশ বছর একাকীত্ব জীবন যাপন করেছেন।
শেষোক্ত নিবন্ধ দুটিতে এখনো রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষের হতে পারলেন না কেন সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ও এর দায়ভার কাদের তা নির্দিষ্ট করেছেন।
আসলে প্রবন্ধ গ্রন্থের মূল্যায়ন করা হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। কেননা, যিনি মননশীল লেখক তার ছেঁকে আনা সারবস্তুর ওপর মূল্যায়নকারী বা আলোচনাকারীর বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়। এখানে যাঁকে নিয়ে আলোচনা তিনি বাংলা সাহিত্যের সুউচ্চে অবস্থানকারী। তাঁর সৃজনের যেকোনো একদিক পড়লে ও ভাবলেই একজন পরিপূর্ণ লেখকের জন্ম হতে পারে। আবার তাঁকে নিয়ে অন্যতম প্রাজ্ঞজন আহমদ রফিকের মূল্যায়ন। সুতরাং কতটা কঠিন কাজ! যাহোক, উপর্যুক্ত গ্রন্থটি অধ্যয়ন আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলের প্রয়াস করেছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস।
রাবীন্দ্রিক সাগরের অন্যতম প্রোজ্জ্বল মুক্তো সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচিত গ্রন্থে গ্রন্থকার রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ পাঠকের মাঝে আরও বিকশিত করেছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ কূপম-ূকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। ছিলেন দূরদর্শী-দার্শনিক? বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে দ্বিচারিতা নিয়েও তিনি মানবতাবাদী, আধ্যাত্মিক, বাউল চেতনা, আধুনিক চেতনা, নাগরিক ও বিশ্বশান্তির প্রবক্তা কবি।

×