
যারা আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করে অবিচল থাকে, তাদের জন্য ভয় ও চিন্তামুক্ত এক চিরস্থায়ী জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মহান আল্লাহ।
পৃথিবীর বুকে প্রতিটি মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য হলো একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁকে একমাত্র প্রতিপালক হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও স্বীকার করা। এটিই ইসলামের মূল ভিত্তি - তাওহিদ। যারা জীবনের সব কঠিন পরিস্থিতিতেও এই ঈমানের ওপর দৃঢ় ও অবিচল থাকেন, তাদের জন্য রয়েছে এক বিশেষ পুরস্কার। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ফেরেশতারা দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের বন্ধু হয়ে যান এবং মৃত্যুকালে জান্নাতের সুসংবাদ নিয়ে হাজির হন।
কোরআনের আলোয় প্রতিশ্রুতির ঘোষণা
আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের জন্য এই বিশেষ পুরস্কারের কথা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সুরা হা-মীম আস-সাজদার ৩০-৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
‘নিশ্চয় যারা বলে, “আল্লাহই আমাদের রব,” অতঃপর অবিচল থাকে, ফেরেশতারা তাদের কাছে নাযিল হয় (এবং বলে,) তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো, তোমাদের যার ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল। আমরা দুনিয়ার জীবনে তোমাদের বন্ধু এবং আখিরাতেও। সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আরও থাকবে যা তোমরা দাবি করবে। এটা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে আপ্যায়ন হিসেবে।’
এই আয়াতটি মুমিনদের জন্য এক বিরাট সান্ত্বনা ও অনুপ্রেরণার উৎস। এখানে ‘রব’ হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করার অর্থ শুধু মুখে বলা নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকেই একমাত্র পালনকর্তা, বিধানদাতা ও উপাস্য হিসেবে মেনে নেওয়া। আর ‘অবিচল থাকা’ মানে হলো—যেকোনো ঝড়-ঝাপটা, লোভ-লালসা বা কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তেও ঈমান ও তাওহিদ থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত না হওয়া।
রাসূল (সা.)-এর অমূল্য নির্দেশনা
ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে অবিচল থাকা, তা একটি বিখ্যাত হাদিসেও বর্ণিত হয়েছে। হজরত সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন একটি جامع কথা বলে দিন, যা আপনার পর আর কারও কাছে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হবে না।’
উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, ‘বলো, আমি আল্লাহর ওপর ঈমান আনলাম, অতঃপর এর ওপর অবিচল থাকো।’ (সহিহ মুসলিম)
এই সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ উপদেশটিই একজন মুমিনের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ঈমান আনার পর সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করাই হলো প্রকৃত সাফল্য।
কখন এবং কীভাবে ফেরেশতারা বন্ধু হন?
যারা ঈমানের ওপর অটল থাকেন, ফেরেশতারা কেবল তাদের পরকালীন জীবনেই নয়, বরং দুনিয়ার জীবনেও তাদের বন্ধু ও সাহায্যকারী হয়ে থাকেন। তবে সবচেয়ে সংকটময় তিনটি মুহূর্তে তারা বিশেষভাবে সাহায্য ও সুসংবাদ প্রদান করেন:
১. মৃত্যুর সময়: যখন মানুষের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় এবং চারপাশের সবকিছু থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন ফেরেশতারা এসে বলেন, ‘ভয় পেয়ো না।’
২. কবরে: মুনকার-নাকিরের সওয়াল-জওয়াবের কঠিন মুহূর্তে ফেরেশতারা তাকে সাহস জোগান এবং সঠিক উত্তর দিতে সাহায্য করেন।
৩. পুনরুত্থানের দিন: হাশরের ময়দানের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে, যখন সবাই ভয়ে আতঙ্কিত থাকবে, তখন ফেরেশতারা ঈমানদার ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করবেন এবং শান্তির পথে এগিয়ে নেবেন।
ফেরেশতাদের এই সুসংবাদ দুটি প্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। প্রথমত, তারা বলেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না’, অর্থাৎ আখিরাতে তোমাদের সামনে যে ভয়াবহ পর্যায়গুলো আসছে, সে সম্পর্কে কোনো আশঙ্কা করো না। দ্বিতীয়ত, তারা বলেন, ‘দুশ্চিন্তা করো না’, অর্থাৎ দুনিয়াতে তোমরা যে পরিবার, সম্পদ ও প্রিয়জনদের ছেড়ে এসেছ, তাদের জন্যও দুঃখ করার কোনো কারণ নেই।
বস্তুত, একজন খাঁটি মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? যে ব্যক্তি তার রবকে চিনেছে এবং তার ওপর নিজেকে সঁপে দিয়েছে, মহান আল্লাহ তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সব পথ সহজ করে দেন এবং ফেরেশতাদের মতো পবিত্র সত্তাদের তার বন্ধু বানিয়ে দেন। এটিই ঈমান ও অবিচলতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিদান।
আফরোজা