
স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী বাম ধারার রাজনীতির অন্যতম পুরোধা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সম্প্রতি একটি টকশোতে স্পষ্টভাবে বলেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমরা ঢাকায় ক্যান্টনমেন্ট করতে দিতে পারি না।”
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, "দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বৈরাচারের আবর্জনা পরিষ্কার করার বদলে বড় দল বলে কথিত দলগুলো তারা আবর্জনা কে কার আঁচলে বেশি করে বাঁধবে, সেইটাতে ব্যস্ত হয়ে গেল।"
টকশোতে আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বলেন, "কালকে চারটা দল নিয়ে বসা হলো। এইটার ভেতর দিয়ে কি এইরকম একটা ধারণার ভিত্তিতে সরকার পরিচালিত হচ্ছে, যে এই চারটা দলের ভেতরে আবার যুদ্ধবিরোধী একটা দল আছে। যুদ্ধবিরোধী শুধু না, ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ দলিলে যেটা ইন্সট্রুমেন্ট অফ সারেন্ডার, সেই কাগজও আমার কাছে আছে, আমি দেখাইতে পারি। সেখানে লেখা আছে, আমরা পাকিস্তানের আর্মি, নেভাল ফোর্স এন্ড এয়ার ফোর্স এলং উইথ অল অক্সিলারি ফোর্সেস, পলিটিক্যাল এন্ড প্যারামিলিটারি, আমরা আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার করছি।"
তিনি আরও যোগ করেন, "সুতরাং আমার বিবেচনায় এই ডকুমেন্টটা ইন্ডিকেট করে ক্লিয়ারলি এন্ড ক্যাটাগরিকালি। পাকিস্তান যদি দুঃখ প্রকাশ করে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আমরা কিন্তু ঢাকায় ক্যান্টনমেন্ট করতে দিতে পারি না। যারা সারেন্ডার করেছে বাই সাইনিং দিস ইন্সট্রুমেন্ট এবং সেইটার কোনো শক্তি কিন্তু বাংলাদেশে কাজ করার অধিকার নেই।"
"সেইরকম একটা দল সহ যে আলোচনা করে সমস্ত জাতির চিন্তাভাবনাকে তারা রিপ্রেজেন্ট করছে, এরকম একটা ধারণার বশবর্তী হয়ে এটা টা নতুন নয়। এর আগেও হয়েছে, সেটা সঠিক বলে আমরা মনে করি না। এইটা হলো কারণ। কিন্তু জিনিসটা খালি এখানেই, এটা কেন এরকম হলো? কেন এরকম হলো?"
উপস্থাপক যখন প্রশ্ন করেন, একদিন চারটি দল, পরদিন ১৩টি দলকে ডাকা হলো—এই বিভাজন কিসের লক্ষণ, তা কি কাউকে অগ্রাধিকার বা প্রিভিলেজ দেওয়ার ইঙ্গিত?
মুজাহিদুল ইসলাম বলেন,"আমরা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শরিক রাজনৈতিক দলগুলো। আমরা তো আজকে থেকে সংগ্রাম শুরু করি নাই। বহুদিন আগে থেকে আইয়ুব আমল থেকে। সার্বজনীন ভোটাধিকার দিতে হবে, দিতে হবে এই চিল্লায় চিল্লায় আমরা কিন্তু আন্দোলন সূত্রপাত করেছি। ভোটের অধিকার দেয় নাই। ভোটের রায় যখন আসলো, ভোট যখন হলো, ভোটের রায় কার্যকর হতে দিল না। তখন আমরা বললাম, এই ভোটের রায় যদি অল পাকিস্তান বেসিসে কার্যকর হতে না দাও, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে হলেও জনগণের ভোটের রায়কে কার্যকর করব।"
তিনি বলেন, "দ্যাট ওয়াজ লজিক, যেটার ভিত্তিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম, যখন ক্র্যাকডাউন হলো, জেনোসাইড শুরু হলো। এখন সেই ভোটাধিকার নিয়ে, পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আমাদেরকে লড়াই চালাতে হয়েছে। আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব। এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমরা একসঙ্গে সংগ্রাম করেছি। সবাই সেই সংগ্রামে ছিলাম।"
তিনি আরও বলেন, "এরশাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও নানা সময় অ্যাকশনে চলেছি। নানা সময় কিছু ভুল বুঝাবুঝি, বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। আবার একত্রিত হয়েছি তিনজোটের রূপরেখার মাধ্যমে। এরশাদ বলল, আমি যে পদত্যাগ করব, পদত্যাগের পথ কোথায়? শান্তিপূর্ণভাবে পদত্যাগের তো কোনো উপায় নাই। তখন আমাকে দায়িত্ব দিল যে কনস্টিটিউশন খুঁজে টুজে বের করো। কিভাবে? তা আমি বললাম ভেরি সিম্পল। এত ধারা অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্টকে তিনি বাতিল করবেন। বাতিল করে আমাদের কমন ডিসিশনে একজনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করবেন। তারপর উনি নিজে রিজাইন করবেন।"
"এত ধারা বলে এবং এত ধারা বলে, নিউলি অ্যাপয়েন্টেড ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিলেন। এবং সেখানে আরো কতগুলো বিষয় ছিল—মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না, আমাদের পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি। এই তিনজোটের রূপরেখা বলে। যাই হোক, এরশাদ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে পতন হয়ে গেল। তখন আমরা রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বসলাম।"
তার মতে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শিখবে—এই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো।
"আবার আমাকে দায়িত্ব দিল যে আপনি ড্রাফট করেন এটা। বিষয়টা হলো এখন রাজনৈতিক দলগুলো কিছু আচরণবিধি অনুসরণ করে চলা উচিত। এবং সেখানে মেইন বেসিসটা ছিল যে আমরা বছর দুয়েক অন্ততপক্ষে দলের স্বার্থটাকে বেশি না দেখে স্বৈরাচারের আবর্জনা পরিষ্কার করার কাজে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বৈরাচারের আবর্জনা পরিষ্কার করার বদলে বড় দল বলে কথিত দলগুলো তারা আবর্জনা কে কার আঁচলে বেশি করে বাঁধবে, সেইটাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। যার ফলে আচরণবিধি হয়নি। এখন যে সিচুয়েশন দাঁড়িয়েছে, আমি মনে করি, জনগণের ভেতরে রাজনৈতিক দল সম্পর্কে একটা অনীহা দাঁড়িয়ে গেছে।"
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক সমালোচনাই নয়, বরং অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত অন্তর্দৃষ্টি এবং ভবিষ্যতের জন্য এক সতর্কবার্তা।
আফরোজা