
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে শনিবার বৈঠক করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনস
গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশের আকাশে কালোমেঘ। চারদিকে নানা উৎকণ্ঠা ও গুঞ্জন। রাজনীতি, কূটনীতিপাড়া থেকে চায়ের দোকানে সর্বমহলে অস্থিরতা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করছেন! নতুন কারও হাতে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। এমন খবরে তীব্র আলোড়ন দেশজুড়ে। বিশেষপাড়া ও পর্দার আড়ালে হয়েছে নানা বৈঠক। অবশেষে গতকাল স্পষ্ট হলো দুই হাজার শহীদ পরিবার ও ৩১ হাজার আহত যোদ্ধায় নতুন বিজয়ে অভ্যুত্থানে গঠিত সরকারে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বপদে থাকছেন। উপদেষ্টা পরিষদেও কোনো রদবদল হবে না।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ ব্যাক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে উৎকণ্ঠা গুঞ্জনের অবসান ঘটেছে। সংকটে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ থাকার সুবাতাস দেওয়া হয়েছে। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জমে থাকা রাগ ক্ষোভেরও বরফ গলেছে। রবিবার ড. ইউনূসের সঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠক হবে বলেও জানা গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, আগামীতে সরকারকে জিম্মি করে চাপ প্রয়োগের পরিবেশ যেন রাজনৈতিক দলগুলো আর না করে সে বিষয়ে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার হত্যাকা-ের বিচার, শহীদ পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং দেশের নাগরিকদের সন্তুষ্ট অনুযায়ী দ্বিতীয় বিজয় পরবর্তী সংস্কার এবং সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজনে সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কখনো প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেনি তাদের দল, জামায়াত জানিয়েছে, এই নির্বাচনের আগে অবশ্যই সংস্কার এবং বিচারের কিছু দৃশ্যমান প্রক্রিয়া চাই ।
বৈঠক শেষে এনসিপি বলছে, হাসিনার অধীনে নির্বাচনকে আদালতে নিয়ে বিশৃঙ্খলা করা হচ্ছে। আমরা সেগুলো আইনগত অবৈধ ঘোষণা চাই। একইসঙ্গে জুলাই গণহত্যার বিচার, সংস্কার, জুলাই সনদ ও গণপরিষদে নির্বাচন চেয়েছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, ডক্টর আব্দুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমদ। জামায়াতের পক্ষে, দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের যমুনায় প্রবেশ করেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপির) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠক ॥ বৈঠকে বিএনপি একটি লিখিত প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে। বৈঠক শেষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, সংস্কার, আওয়ামী লীগের বিচার এবং নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি মনে করে এই তিনটি কাজ একসঙ্গে চলতে পারে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে বিএনপি দাবি জানিয়েছে। বিএনপি কখনো প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি বিতর্কিত উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি করেছে।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র উত্তরণের লক্ষ্যে বিএনপি প্রথম থেকেই একটি সুস্পষ্ট জাতীয় নির্বাচনী রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। আপনারা জানেন যে, আমরা এটা প্রকাশ্যভাবে দাবি করে আসছি। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও পারিবারিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলে এবং সেজন্য আওয়ামী লীগের বিচার সবচেয়ে বেশি দাবি করে বিএনপি। এই বিচার প্রক্রিয়া কোনোভাবে অসম্পূর্ণ থাকলে বিএনপি সরকারে যখন যাবে, তখন স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্কার কার্যক্রম অবিলম্বে সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্রুত রোডম্যাপ প্রদানের দাবি জানিয়েছি আমরা। মোশাররফ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যে কোনো উসিলায় নির্বাচন যত বিলম্ব করা হবে আমরা মনে করি, আবার স্বৈরাচার পুনরায় ফিরে আসার পথ তৈরি হবে এবং এর দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকারের।
প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ গুঞ্জন নিয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপি সম্পর্কে যে নানা রকমের গুজব আছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে বলেছি বিএনপি কখনোই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায়নি। বরং প্রথম দিন থেকেই এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা সহযোগিতা করে আসছি।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ বিষয়ে স্পেসিফিক কোনো আলোচনা হয় নাই। আমরা দাবি করেছি। হয়তো বা তারা প্রেসের মাধ্যমে জানাবেন, আমরা অপেক্ষায় আছি। তারা জানানোর পরে আমরা প্রতিক্রিয়া জানাবো।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ডিসেম্বরে আগেও নির্বাচন করা সম্ভব, এ আলোচনাও হয়েছে।
জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক ॥ শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। বৈঠকে জামায়াত আমিরের সঙ্গে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ উপস্থিত ছিলেন।
এ দিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে মূলত দুটি বিষয়ে স্পষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছেন তারা। রাত সাড়ে ৯টায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমরা বলেছি দুইটা বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। একটা বলেছি, নির্বাচনটা কখন হবে? আপনি যে সময়সীমা দিয়েছেন, এর ভেতরেই জনগণের কোনো বড় ধরনের ভোগান্তি না হয়ে একটা কমফোর্টেবল টাইমে নির্বাচনটা হওয়া দরকার।
দুই নম্বর আমরা বলেছি, এই নির্বাচনের আগে অবশ্যই সংস্কার এবং বিচারের কিছু দৃশ্যমান প্রক্রিয়া চাই যা জনগণের সামনে আসতে হবে। জামায়াত আমির বলেন, সংস্কার শেষ না করে যদি কোনো নির্বাচন হয়, এই নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। আবার সব সংস্কার এখন করা সম্ভবও না। মাত্র ৫টা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তারা হাত দিয়েছেন। এতটুকু নিষ্পত্তি করা দরকার সন্তোষজনকভাবে।
প্রধান উপদেষ্টা মনোযোগ সহকারে আমাদের কথাগুলো শুনেছেন। তিনি বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। তিনি বলেন, সংস্কার এবং বিচারের মধ্যদিয়ে একটি অর্থবহ নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে সমতল মাঠ থাকবে। অংশ নেয়াদের কাউকে কোনো ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হবে না। কোনো পেশিশক্তি দেখতে হবে না। প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে কয়েকবার বলেছেন তিনি এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন দিতে চান। কিন্তু নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। এটিকে কেন্দ্র করে রোপম্যাপের দাবি এসেছে।
এনসিপির সঙ্গে বৈঠক ॥ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে শনিবার রাতে বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে আসেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপির) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, আজকে উনি আমাদেরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আমরা ওনাকে আহ্বান করেছি অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্খায় দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সেটা যেন বাস্তবায়ন করেন। আমরা বলেছি ৩০ দিনের মধ্যে যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার ডেটলাইন দেওয়া হয়েছে তার মধ্যেই যেন দেওয়া হয়। তিনি আমাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন, সেটি হবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আহত হয়েছে তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটা ধীর গতিতে আগাচ্ছে। এখনও অনেক শহীদ পরিবার মাসিক সঞ্চয় পায়নি। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চেয়েছি। হাসিনার অধীনে হওয়া সকল নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে বলেছি। তখন ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচন হয়নি দেশে। রাতের ভোট, ডামি ভোট হয়েছে। তখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও সেই নির্বাচন বয়কট করেছেন।
আমরা দেখছি হাসিনার অধিনে নির্বাচনকে আদালতে নিয়ে বিশৃঙ্খলা করা হচ্ছে। আমরা সেগুলো আইনগত অবৈধ ঘোষণা চাই। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রাখতে পারছি না। কমিশন পুনর্গঠন করে আমরা দ্রুত স্থায়ীয় সরকার নির্বাচন চেয়েছি। মোটা দাগে বলতে গেলে আমরা জুলাই গণহত্যার বিচার, সংস্কার, জুলাই সনদ ও গণপরিষদে নির্বাচন চেয়েছি।
ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথাই বলেছেন ড. ইউনূস-প্রেস সচিব ॥ তিন দলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথাই আবার তুলে ধরেছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শনিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন প্রেস সচিব।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রেস সচিব বলেন, আজকের বৈঠকে বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছেন। তবে বৈঠকে ড. মোহাম্মদ ইউনূস আগামী ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের জুনের মধ্যে হবে।
তিনি বলেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে এনসিপি ও জামায়াত দ্বিমত পোষণ করেনি। জামায়াতে ইসলাম মনে করছে, চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত লেগে যাবে, তাই তারা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের টাইমলাইনকে সমর্থন জানিয়েছে। তারা বলেছে যে, এতে তাদের সমর্থন আছে। শফিকুল আলম বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টাকে সমর্থন জানিয়েছে। তারা অনুরোধ করেছে নির্বাচন শেষ না করে তিনি যেন পদত্যাগ না করেন।
তিনি বলেন, খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। এনসিপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন চেয়েছে। শেখ হাসিনার আমলের সব নির্বাচন বাতিল চেয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের বিষয়ে বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সরকার কিছু বলেনি।