
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে জাতীয় নাগরিক পার্টি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নৌকা মার্কাকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। বিচার চলাকালে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের নয় মাস পরেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে আমাদের রাজপথে নামতে হয়েছে- এটা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা। জাতির কাছে আমাদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল বিগত ফ্যাসিবাদী আমলের বিচার নিশ্চিত করা এবং দেশের সংস্কার।
শুক্রবার বেলা তিনটায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। দলটির ঢাকা মহানগর ইউনিটের আয়োজনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। সমাবেশে খ- খ- মিছিল নিয়ে যোগ দেন দলটির নেতাকর্মীরা। এরপর মঞ্চে বক্তব্য দিতে শুরু করেন এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এর আগে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের এবং ঢাকার বাইরের জেলা থেকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে সমাবেশে আসেন। ঢাকঢোল বাজিয়ে অনেককে আসতে দেখা গেছে। এ ছাড়া অনেকের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড।
বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে জুলাই ঘোষণাপত্র এখনো আসছে না উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ’২৪-এ প্রথমবার রাজপথে নেমে আসেনি, জীবন দেয়নি। এর আগে বহুবার এ দেশের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে, জীবন দিয়েছে। ১৯৭১ সালের পরে ১৯৭২ সালে আমার সোনার বাংলার স্বপ্ন মুজিববাদীদের হাতে বেহাত হয়ে গিয়েছিল। দেশটাকে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশের আকাক্সক্ষা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছিল। মুজিববাদী সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছিল। সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র নামে বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছিল। দেশের জনগণ নব্বইয়ে রাজপথে নেমে স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল। কিন্তু ৩০ বছর পরে আবারও সেই স্বৈরতন্ত্র ফিরে এসেছিল। আমরা সবাই জানি, বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ কীভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা যখন তাদের অধিকারের জন্য রাজপথে নেমে এসেছিল, এ দেশের পুলিশ সেনাবাহিনী বিজিবিকে দিয়ে গুলি চালিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। নিবন্ধন বাতিল করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি, যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তারা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। মামলা-বাণিজ্য করা হচ্ছে। তৃণমূলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। আমরা দেখেছি, কিছু সাংবাদিক প্রশ্ন করছে, শেখ হাসিনা গণহত্যাকারী কি না! সেই সব সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর।
আওয়ামী লীগ খুনিদের দল কি না? খুনিরা কি এই বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে? সন্ত্রাসীরা কি এই বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে? আমরা এই বাংলাদেশে খুনি, সন্ত্রাসী ও আওয়ামী লীগের চাই কি না? উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এই প্রশ্নগুলো রাখেন এনসিপি উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তার এই প্রশ্নের উত্তরে মঞ্চের সামনে থেকে সমস্বরে উত্তর আসে ‘না, না’।
এরপর তিনি স্লোগান দেন, অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন। খুনিদের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন। ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।
সারজিস আলম বলেন, আওয়ামী লীগ পিলখানা, শাপলা চত্বর, জুলাই গণহত্যা ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগ খুনিদের দল। খুনিরা রাজনীতি করতে পারবে না। খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই। তিনি বলেন, ৯ মাস আগে শহীদ মিনারের মতো আজও ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন।
সমাবেশে কোনো ধরনের যদি কিন্তু ছাড়াই গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
তিনি বলেন, শুধু একটা কথাই বলব, ড. ইউনূস আপনাকে আমরা আহত এবং শহীদদের রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছি। আমরা কোনো অনুরোধ করছি না, সরাসরি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছি, আওয়ামী লীগকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ বিগত ১৫ বছরে যে গণহত্যা, গুম, খুন করেছে সেটা প্রমাণিত। সুতরাং কোনো যদি কিন্তু ছাড়াই এই গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
নেতাদের বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে ‘এই মুহূর্তে দরকার, বিচার আর সংস্কার’, ‘চব্বিশের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’, ‘আওয়ামী লীগের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, আওয়ামী লীগ নো মোর’, ‘ব্যান করো ব্যান করো, আওয়ামী লীগ ব্যান করো’ প্রভৃতি বলে স্লোগান দেন এনসিপির নেতাকর্মীরা।
সমাবেশে বক্তব্যে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম বলেন, গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা টালবাহানা দেখতে পাচ্ছি, এটা লজ্জাজনক। আমাদের হাইকোর্ট দেখাবেন না। হাইকোর্ট দেখে জুলাই বিপ্লব হয়নি। তারিকুল আরও বলেন, অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
এ ব্যাপারে তারা কোনো আমলাতন্ত্রিক জটিলতা দেখতে চান না। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আগে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কারের পর নির্বাচনে যেতে হবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন বলেন, খুনি হাসিনাকে আমরা বিদায় করেছি। এই বিজয় আমাদের ধরে রাখতে হবে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই বাংলার মাটিতে আওয়ামী লীগ আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ।
দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দীন মাহাদী বলেন, খুনি হাসিনাকে বাংলাদেশে এনে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে হবে। এ ছাড়া মৌলিক সংস্কার ছাড়া আবারও একটি নির্বাচনের দিকে যাওয়া হলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে গাদ্দারি করা হবে। আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক আতিক মুজাহিদ বলেন, আমাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য আওয়ামী লীগ ও হাসিনার দোসররা হুমকি। এরা বাংলাদেশে থাকতে পারে না।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর দেশের মানুষকে শোষণ করেছে জানিয়ে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব হুমায়রা নূর বলেন, দেশের মানুষকে তারা ভোট দিতে দেয়নি। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তার জন্য অবশ্যই দুর্নীতিপরায়ণ, খুনি-গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। দিল্লির ‘প্রেসক্রিপশনে’ বাংলাদেশ আর চলবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মাহিন সরকার বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে ন্যূনতম টালবাহানা করবেন না। মৌলিক সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন নয়।
দলের যুগ্ম সদস্য সচিব তাহসীন রিয়াজ বলেন, আগামীর রাজনীতি হবে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ থেকে ছুড়ে ফেলার রাজনীতি। যে সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে, তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার রাজনীতি। দলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আলী নাছের খান বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলবে কি চলবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
এনসিপির সংগঠক মোস্তাক আহমেদ শিশির বলেন, এই দেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে, সেই সিদ্ধান্ত জনগণ ৫ আগস্টই দিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হলে জুলাই যোদ্ধারা তা প্রতিহত করবে। সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ খালেদ সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসানও সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের বুকে ৭০টা গুলি করা হয়েছিল। একটা মানুষকে মারতে কত গুলি করতে হয়? হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না, স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী হাসিনা ও তার দোসরদের কোনো স্থান হবে না।