
জীবন্ত প্রাণী হত্যা ছাড়াই তৈরি হচ্ছে আসল মাংস।বিজ্ঞান এখন সেই অদ্ভুত বাস্তবতাকে এনে দিয়েছে আমাদের সামনে। প্রশ্ন উঠছে, এটি কি ভবিষ্যতে প্রাণীজ খাদ্য শিল্পকে পুরোপুরি পাল্টে দেবে?
সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রে বেলিভার মিটস-এর পরীক্ষাগারে রান্না হচ্ছিল মাংস। তবে এটি কোনও সাধারণ মাংস নয়।সেল থেকে তৈরি, যার জন্য কোনও মুরগি জবাই হয়নি। রান্নার সময় সুপরিচিত মাংসের গন্ধে ভরে উঠেছিল গোটা রান্নাঘর। এই উদ্ভাবনকে ঘিরে এখন দুনিয়া জুড়ে আশাবাদী বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা ও পরিবেশকর্মীরা।
প্রাণী ছাড়াই তৈরি হচ্ছে মাংস
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার দুই কোম্পানি, আপসাইড ফুডস ও গুড মিট সম্প্রতি সরকারের অনুমোদন পেয়েছে।তারা এখন বাজারে বিক্রি করতে পারবে প্রাণীর কোষ থেকে জন্মানো মাংস।এই মাংস উৎপাদনে কোনও প্রাণীকে লালন-পালন বা জবাইয়ের দরকার পড়ে না। ফলে এটি প্রাণীদের জন্য যেমন কল্যাণকর, তেমনি পরিবেশের জন্যও। বিশাল পরিমাণ জমি আর পশুখাদ্য উৎপাদনের দরকার পড়ে না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে মোট জমির অর্ধেকেরও বেশি ব্যবহৃত হয় পশু চাষের জন্য।
কী এই কোষচাষ মাংস?
এই মাংস উৎপাদিত হয় প্রাণীর কোষ নিয়ে স্টিলের ট্যাঙ্কে চাষ করে। এটি শিল্পে পরিচিত ‘কাল্টিভেটেড মিট’ নামে। কেউ বলেন ‘ল্যাব গ্রোন মিট’, কেউ বলেন ‘সেল-বেইজড মিট’।
বিশ্বজুড়ে ১৫০টির বেশি কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের মাংস-মুরগি, গরু, শুকর, এমনকি ভেড়ার মাংস এইভাবে তৈরি করতে কাজ করছে।
কোথায় পাবেন এই মাংস?
এই মুহূর্তে দোকানে গিয়ে এই মাংস কিনে আনা সম্ভব নয়। প্রথমদিকে এটি থাকবে কিছু নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যে এটি আরও রেস্তোরাঁ ও ক্ষুদ্র খুচরা বিক্রেতার কাছে পৌঁছাবে, আর ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পৌঁছাবে সুপারমার্কেটের তাকেও।
কীভাবে তৈরি হয়?
প্রথমে সংগ্রহ করা হয় প্রাণীর কোষ। এটি হতে পারে উর্বর ডিম থেকে, কোষের স্টোরেজ ব্যাংক থেকে বা কোনও জীবন্ত প্রাণীর টিস্যু থেকে।
এই কোষগুলো একটি পুষ্টিকর ‘ব্রথ’-এর সঙ্গে মিশিয়ে বড় করা হয়। এরপর সেগুলো পরিণত হয় পেশি, চর্বি ও সংযোজক টিস্যুতে। কয়েকদিন বা সপ্তাহ পর কোষগুলো ট্যাঙ্ক থেকে তুলে তৈরি করা হয় নাগেটস বা হ্যামবার্গারের মতো খাবার।
কিছু কোম্পানি কাজ করছে আরও জটিল গঠন যেমন মুরগির বুকের মাংস বা স্টেক তৈরি নিয়ে। এসবের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ কাঠামো বা ‘স্ক্যাফোল্ড’, যেখানে কোষগুলো বাড়তে পারে।
এটা কি সত্যিকারের মাংস?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একেবারে আসল মাংস।শুধু তৈরি হচ্ছে ভিন্নভাবে। এটি প্ল্যান্ট-বেইজড খাবার নয়। কিছু কাল্টিভেটেড মাংসে সামান্য সবজি প্রোটিন মেশানো হয়।
মানুষ কি খাবে এই মাংস?
'গুড ফুড ইনস্টিটিউট'-এর প্রেসিডেন্ট ব্রুস ফ্রিডরিখ বলেন, ‘‘যতক্ষণ না এই মাংসের দাম ও স্বাদ সাধারণ মাংসের সমান হচ্ছে, ততক্ষণ এটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।’’
যুক্তরাষ্ট্রে একটি জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্কই বলেছেন তারা এটি খাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর মধ্যে অনেকে এটিকে নিরাপদ মনে করছেন না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, সেল-বেইজড খাবারে কিছু নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ থাকতে পারে।যেমন, ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, অবাঞ্ছিত বায়োলজিক্যাল রেসিডিউ বা অ্যালার্জি ঘটাতে পারে এমন উপাদান।তবে একে বাদ দিয়ে নিরাপদ বলা যায় না প্রচলিত মাংসকেও। কারণ, সেগুলোর মধ্যেও জবাই ও প্রক্রিয়াকরণের সময় নানা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
সেল-চাষে জন্মানো মাংস এখন আর কোনও কল্পনা নয়। বিজ্ঞান এই 'ভবিষ্যতের মাংস'কে বাস্তবের মুখ দেখিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, কত দ্রুত এই খাদ্য বিপ্লব আমাদের প্লেট বদলে দেয় এবং প্রাণী ও প্রকৃতির জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
সূত্র:AP
আফরোজা