ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১

আরপিওর তোয়াক্কা নেই

বিএনপির কাউন্সিল হয় না ৮ বছর

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বিএনপির কাউন্সিল হয় না ৮ বছর

রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হয় না ৮ বছর

রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হয় না ৮ বছর। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩ বছর পর পর কাউন্সিল করার বাধ্যবাদকতা থাকলেও এর তোয়াক্কা করছে না বিএনপি। তাই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতেই চলছে  নেতা নিয়োগ। সর্বশেষ ২১ ফেব্রুয়ারি, বুধবারও ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম জামালকে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় কমিটির পদবঞ্চিত বিএনপি নেতারা চরম ক্ষুব্ধ বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় । 
রাজপথের আন্দোলনে ব্যর্থ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায়। দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মী রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অনেক নেতাকর্মী বন্দি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন প্রবাসী। এ পরিস্থিতিতে দলের সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠন ও জাতীয় কাউন্সিল করে সামনে এগিয়ে যাওয়া জরুরি বলে বিএনপির মঙ্গল চায় এমন দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল মনে করলেও দলটির হাইকমান্ডের এ নিয়ে কোনো চিন্তাই নেই বলে সূত্র জানায়। 
বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। এর পর ৮ বছর ধরে জাতীয় জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না। দলের একটি বড় অংশ ২০১৯ সাল থেকে বারবার জাতীয় কাউন্সিলের দাবি জানিয়ে এলেও বিএনপি হাইকমান্ড চায় না বলে তা সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে দলটির একটি বড় অংশ ক্ষুব্ধ থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ বলতে সাহস পাচ্ছে না। পদ হারানোর ভয়ে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। 
সূত্র মতে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার বাধ্যবাদকতা থাকলেও বিএনপি তা তোয়াক্কা করছে না। করোনাকালে কাউন্সিলের জন্য সময় বৃদ্ধির আবেদন করলেও এখন নিবন্ধন ঝুঁকিতে থাকার পরও  দলের নেতারা এ নিয়ে কিছু ভাবছে না। তাই ইসি আইন অনুসারে যে কোনো সময় বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

এটি জানার পরও বিএনপি হাইকমান্ড দলের কাউন্সিলের চিন্তা না করে নতুন করে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিচ্ছে। অথচ যোগ্যতা থাকার পরও যুগ যুগ ধরে কেন্দ্রীয় কমিটির পদ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন যারা তাদের পদ দেওয়া হচ্ছে না বলে জানা যায়। 
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না আসায় বিএনপি কিছুটা নিবন্ধন ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, কোনো কারণে আর একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেই আরপিও অনুসারে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে।

এ ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চোরাগোপ্তা হামলা করে সরকারি- বেসনকারি সম্পদ বিনিষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে বিএনপির বিরুদ্ধে। এর আগে বিএনপি ২০১৩ সালে টানা  বেশ ক’দিন এবং ২০১৫ সালে লাগাতার ৯৩ দিন হরতাল ও অবরোধকর্মসূচি পালনকালে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপসহ বিভিন্নভাবে জ্বালাওপোড়াও করায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এসব নাশকতামূলক কর্মকা-সহ বিএনপির বিরুদ্ধে দেশবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের অভিযোগ সরকার ও বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়।

এ পরিস্থিতিতে  কোনো কোনো মহল থেকে দলটিকে নিষিদ্ধ করারও দাবি উঠেছে। তাই সরকার কোনো গ্রাউন্ডে বিএনপিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত করলে আরপিও’র ১১ (খ) ধারা অনুসারে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। এ ছাড়া দ্রুত জাতীয় কাউন্সিল করে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন না করলে বা আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন কমিশন সরাসরি বিএনপির নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে বলে ইসি সূত্র জানায়। 
আরপিও’র ১১ (গ) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে প্রেরিতব্য কোনো তথ্য রাজনৈতিক দলগুলো পর পর ৩ বছর প্রেরণ করতে ব্যর্থ হলে নিবন্ধন বাতিল হয়। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রেও বিএনপির ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, দলটি সব তথ্য ইসিতে নিয়মিত প্রেরণ করে না। আরপিওর ১১(ঙ) পর পর দুইটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হয়। বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় এর পরের নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হবে। এ ক্ষেত্রেও বিএনপি কিছুটা ঝঁকিতে আছে। কোনো কারণে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল নিশ্চিত হয়ে যাবে। আরপিও’র ১১ (চ) অনুসারে ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করে সংশোধিত গঠনতন্ত্র দাখিলে ব্যর্থ হলেও নিবন্ধন বাতিল হয়। তাই এ ক্ষেত্রে বিএনপি নিবন্ধন ঝঁকিতে রয়েছে। 
উল্রেখ্য, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এর পর প্রায় ৮ বছর সময় অতিক্রম হয়ে গেলেও জাতীয় কাউন্সিল করার কোন ইচ্ছে নেই দলটির। তবে জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই তারা দলের মেয়াদউত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখনও বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন পদের দায়িত্ব দিচ্ছেন। প্রায় একই সময়ে জাতীয় কাউন্সিল করার পর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অন্যান্য দলগুলো আরও দুইবার কাউন্সিল করে ফেলেলেও বিএনপি তা করেনি। 
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেশ ক’দফা জাতীয় কাউন্সিল করার কথা দলীয় শীর্ষ পর্যায় থেকে  হলেও শেষ পর্যন্ত আর তা করার চেষ্টা করেনি বিএনপি। অবশ্য এর পর করোনাকালে নির্বাচন কমিশন থেকে জাতীয় কাউন্সিল করতে সময় বাড়িয়ে নেয় তারা। তবে করোনা পরিস্থিতি ভাল হলে জাতীয় কাউন্সিল করবে বলে নির্বাচন কমিশনকে জানালেও পরে সার্বিক পরিস্থিতি অনুকুলে থাকার পরও আর জাতীয় কাউন্সিল করেনি বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলে রাজনীতি করলেও তাদের দলেই গণতন্ত্র নেই। তাই তারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) তোয়াক্কা করছে না। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও বার বার জাতীয় কাউন্সিলের দাবি তুলছেন। কিন্তু বিএনপি হাইকমান্ড তাদের দাবি আমলে নিচ্ছেন না। 
বিএনপির গঠনতন্ত্রেও ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সে হিসেবে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ আগের কাউন্সিল হওয়ায় পরবর্তী কাউন্সিল ২০১৯ সালের ১৯ মার্চের মধ্যে হওয়ার কথা থাকলেও তারা তা করেনি। দলের গঠনতন্ত্র এবং আরপিও কোনটারই তোয়াক্কা করছে না বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকায় লন্ডন প্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান  রাজি না থাকায় যতবারই দলের কাউন্সিলের চেষ্টা হয়েছে ততবারই সে চেষ্টা ব্যাহত হয়েছে।

তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাউন্সিল না হলে যে কোনো সময় দলের নেতাকর্মীরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে বিএনপির জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। 
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের ক’জন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর সবাই আশা করেছিলেন জাতীয় কাউন্সিল করে দলের সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার লক্ষ্যণ দেখা যাচ্ছে না। আগের জাতীয় কাউন্সিলের পর ৮ বছর পার হলেও আমরা জাতীয় কাউন্সিল করতে পারছি না। এ কারণে, অনেক যোগ্য নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে পারছে না।

দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে শূন্য থাকা অনেক পদ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো পদে এখনো নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দলের ত্যাগী নেতারা চান জাতীয় কাউন্সিলর পর শূন্য পদগুলো পূরণ করা হোক এবং যারা দলে নিষ্ক্রিয় তাদের বাদ দিয়ে সক্রিয় নেতাদের সম্পৃক্ত করা হোক।   
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন।  এর আগে দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সর্বস্তরে দল গুছিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে গণফেরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলকে ঢেলে সাজাতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের দাবি তুললেও এ বিষয়ে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেক রহমান রাজি না থাকায় তখন জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি বিএনপি। এর পর আরও কয়েক দফা দলের সিনিয়র নেতারা জাতীয় কাউন্সিলের দাবিতে সোচ্চার হন। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও দলের একাংশ জাতীয় কাউন্সিলের দাবি তুলে। কিন্তু তাদের দাবি আমলে নিচ্ছে না বিএনপি হাইকমান্ড।

×