ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

একান্ত সাক্ষাৎকারে তৈমুর আলম খন্দকার

আগামী নির্বাচনে ৩শ’ আসনেই প্রার্থী দেবে তৃণমূল বিএনপি

বিকাশ দত্ত

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আগামী নির্বাচনে ৩শ’ আসনেই প্রার্থী দেবে তৃণমূল বিএনপি

তৈমুর আলম খন্দকার

তৃণমূল বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দেবে। নির্বাচনে বড় দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হবে কি না- সে বিষয়ে দলের পরবর্তী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, প্রথমত দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই তৃণমূলের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। একক নেতার সিদ্ধান্তে দল চলবে না। সমষ্টিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপিতে থাকা অবস্থায় আমি দলের কোনো সমালোচনা করিনি। এখনো করি না। বিএনপি থেকে বহিষ্কার করার পরও আমি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করছি। বিএনপি ডাকলে আবার যাবেন কি না- এই উত্তরে তিনি বলেন, সেটা সম্ভব নয়। 
গত মঙ্গলবার তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান করেই দলের মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। দেড় বছর আগে বিএনপি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। বিএনপি থেকে বহিষ্কার এবং তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি জনকণ্ঠের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমার দল (বিএনপি) তো আমাকে বহিষ্কার করেছে। এরপর আমি দেড় বছর অপেক্ষা করেছি একটা শোকজ নোটিসের জন্য। কেন বহিষ্কার করা হলো- আমাকে জানান। বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামে এই দলের পতাকা বহন করেছি। আমি মনে করছি, আগে যে রাজনীতি করতাম সেই দলের সঙ্গে এই নামের ও আদর্শের মিল আছে এবং নাজমুল হুদা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনিও এই দলেরও প্রতিষ্ঠাতা। এজন্য এই দলে আমি যোগ দিয়েছি। এই দলের প্রতিটি সদস্য তৃণমূলের। কেউ কারও ওপর খবরদারি করতে পারবে না। আমরা নির্বাচনে যাব। এর আগে আমাদের অবশ্যই আলাপ-আলোচনা করতে হবে। 
তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানের পর কেউ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এখন মনোযোগ দিয়েছি দলকে গোছানোর কাজে। দলকে সাংগাঠনিকভাবে  শক্তিশালী করতে হবে। তৃণমূল বিএনপি ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য হলো এখানে সংগঠন একক সিদ্ধান্তে চলবে না। সংগঠন চলতে হলে সমষ্টিগত সিদ্ধান্তে চলতে হবে। কোনো ইউনিয়ন, থানা জেলা কমিটিকে চাপিয়ে দেব না। নিজ নিজ জেলায় বসে তারা কমিটি করবে। সিদ্ধান্ত এক্সিকিউটিভ কমিটির মিটিংয়ে নেওয়া হবে।

বড় ধরনের সিদ্ধান্ত কাউন্সিল করে নেওয়া হবে। আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে। এ ছাড়া নীতিগতভাবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, মৌলিক মানবাধিকার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে এ দুই দলের মধ্যে পার্থক্য নেই। 
অনেকেই মনে করছে বিএনপি আর তৃণমূল বিএনপি কার্যক্রম একই- এ বিষয়ে অভিমত জানতে চাইলে তৈমূর বলেন, ভারতে  তৃণমূল কংগ্রেস আছে। ও রকম কোনো পার্থক্য নেই। 
তৃণমূল বিএনপিতে কেন আসলেন- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রথম কারণ হলো আদর্শগত মিল আছে। দ্বিতীয়ত আমার আগের দল আমাকে বহিষ্কার করেছে। আমিতো আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই রাজপথে আছি। কোনো না কোনোভাবে রাজপথে মিছিল-মিটিংয়ে আছি। আমার দল আমাকে বহিষ্কার করেছে দেড় বছর। এই দেড় বছরও আমি দলের কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। প্রশ্ন হলো, আমি দলের (বিএনপি) বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ করি নাই। এখনো করব না। কারণ কাকের মাংস কাকে খাওয়া  উচিত নয়। আমি দেড় বছর অপেক্ষা করলাম। এ পর্যন্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাইনি। আমি মনে করেছি, দলের এখন অত্যন্ত সুসময়। এখন বিএনপি আমাকে প্রয়োজন মনে করে না। এজন্যই আরেকটা প্লাটফর্ম বেছে নিয়েছি। কথা বলার জন্য রাজনীতি করার জন্য। 

তৃণমূল বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপি বা তৃণমূল বিএনপি তো নির্বাচনমুখী দল। কিন্তু নির্বাচনের নিশ্চয়তা তো পেতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা পেলে অবশ্যই নির্বাচনে যাবে তৃণমূল বিএনপি। এখন নির্বাচনটা ফ্রি ফেয়ার হতে হবে। আমরা নির্বাচন করতে চাই। আর একক সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কাউন্সিল হবে মিটিং হবে। সেখানে দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। 
তৃণমূল বিএনপি নির্বাচনে কত আসনে প্রার্থী দেবেÑ সে প্রসঙ্গে তৈমূর বলেন, আমরা এখন দল গোছানোর কথা বলছি। তিনশ’ আসানেই প্রস্তুতি থাকবে। আমরা নির্বাচনে যাই বা না যাই, আমাদের প্রস্তুতি থাকবে তিনশ’ আসনের। 
বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে যাবেন কিনাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপমহাদেশে জোটের একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে। যেমন- কর্নেল ওলি সাহেব, বি চৌধুরী তারা তো বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত। কিন্তু তারা পরবর্তী সময়ে বিএনপির সঙ্গে জোট করেছে। আবার হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। প্রবীণ নেতা শেখ সেলিম বলছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছে জাসদ। তারপরও জাসদের সঙ্গে আওয়ামী লীগও জোট করেছে। আমাদের সম্মেলনে ৩০-৩৫টি দলের নেতা এসেছিলেন তারা বক্তব্য রাখছেন।

তারাও আমাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকতে চান। আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে জোট-মহাজোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেব। 
তৃণমূল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিটা প্রথম করেছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। এই দাবি করাতে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দেওয়া হয়। দলের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কেয়ারটেকার সরকারের প্রতি সমর্থক দিয়ে ছিলেন। এখন আমরা পরিস্থিতি পরিবেশ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব। 
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের পরিধি বাড়ছে না, প্রযোজনে মহাজোট হবে। তৃণমূল কি সেই মহাজোটে যোগদান করবে কিনাÑ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটা আমাদের সময় বলে দেবে। 
বিএনপি আপনাকে কি দিয়েছে আর আপনি বিএনপিকে কি দিয়েছেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তৈমূর বলেন, দল ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়া আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জে দলের নেতাকর্মীদের জন্য লিগ্যাল এইড কমিটি করি। তখন খালেদা জিয়া আমাকে ডেকে নিয়ে মহানগর বিএনপির কনভেনার করেন। পরবর্তী সময়ে অনেক পদ দেন।  বিআরটিসির চেয়ারম্যান করেন। আমি বহিষ্কার একবার হয়েছি। আর নির্বাচন করতে পারি নাই। ২০১১ তে আমাকে বসিয়েছে তাতে কোনো আপত্তি নেই। দুঃখ হলো আমি জানার আগে প্রতিপক্ষের যে সরকারি দলের প্রার্থী সে জেনে গেল। তিনি প্রচার করলেন, আমাকে বসিয়ে দিবে। এরপরও দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেইনি।

বিএনপির মহাসচিব বলেছেন বিএনপি বিশাল প্রবাহমান নদী। কিছু খড়কুটো আসে আবার চলে যায়। এ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কি?Ñ এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় যাইনি। বিএনপির মহাসচিব একজন সম্মানিত ব্যক্তি। উনি আমাকে খড়কুটোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমি মনে করি, আমি খড়কুটোর চেয়েও নি¤œস্তরের লোক। খড়কুটোর তো একটা অবস্থান আছে। আমার সেই অবস্থানটাও নেই। তবে খড়কুটো যখন পায়ে বাঁধে তখন কিন্তু হোঁচট খেতে হয়। আর নাকে মুখে যখন লেগে যায় তখন তো কি অবস্থা হয় তা বুঝেন। 
আপনি তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানের পর আপনার ছোট ভাই মাকসুদ আলম খন্দকার বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। এটার বিষয়ে মতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছোট ভাই বিএনপিতে আছে, তারা বিএনপি করবে। আমার ১৪ গোষ্ঠী বিএনপির সঙ্গে জড়িত। আমার মেয়ে করে, ভাই করে, আত্মীয়স্বজন করে। তাদের আমি অভিভাবকÑ এটা তো স্বীকার করে আমি তাদের ভরসাস্থল এটাও তারা বলছে। তাদের ডেকে বলেছি আমি যখন বিএনপিতে যোগ দেই, একক সিদ্ধান্তে যোগ দেই। তৃণমূলে যখন যোগ দিলাম একক সিদ্ধান্তেই দিয়েছি। তোদের এখানে আসা দরকার নেই। তোরা তোদের রাজনীতি কর। 
দল যদি আপনাকে আবার ডাকে তা হলে কি করবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তৈমূর বলেন, সেই সুযোগ নেই। দল মনে করলে আগেই আমাকে ডাক তো। বহিষ্কারের পর দেড় বছর অপেক্ষা করতে হতো না। আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়নি। বিএনপিতে এখন আমার মতো খড়কুটোর প্রয়োজন নেই।  
বিএনপি আপনাকে বহিষ্কার করলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আবেদন করেছেন। বিষয়টি তৃণমূল বিএনপির  নেতারা কিভাবে দেখছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, নীতিগতভাবে আমি খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেছি। অনেকে তো দল থেকে চলে গেলে দলকে দুর্নাম করে। এনাম আহম্মেদ বলেছেন বিএনপি করে আমি ভুল করেছি। এ ধরনের কথা আমি বলছি না। আমি দলের সমালোচনা আগেও করিনি। এখনো করি না। 
বিএনপি বহিষ্কার করার পর আপনি বড় দল আওয়ামী লীগে যোগ দান করলেন না কেন- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিছু লোক আছে মূর্খ। কিছু লোক আছে জ্ঞান পাপী। কিছু লোক আছে ইচ্ছাকৃতভাবে বলে। কিছু লোক আছে বুঝে না বুঝে বলে। এদের বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আমি বিএনপি ছেড়ে তৃণমূল বিএনপিতে আসছি সত্য না। আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দেড় বছর অপেক্ষা করছি। দল আমার প্রতি সুবিচার করেছে, নাকি অবিচার করেছে, জাতি সেটা দেখবে। আমাকে দেড় বছর আগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারপর একদিনের জন্যও ডাকেনি। এখন ডাকার কোনো সম্ভাবনা দেখি না।’
বিএনপি নির্বাচনে না আসলে সে ক্ষেত্রে কি করবেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটার জন্য আমরা পরিবেশ পরিস্থিতি দেখব। তবে সরকারকে জনগণের আস্থায় আসতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে হবে। 
দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে কিনা- এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশবাসী সোচ্চার বিদেশীরা সোচ্চার। জাতিসংঘ সোচ্চার। কূটনীতিকরা সোচ্চার। সে হিসেবে সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করছি। নতুবা দেশে সংকট দেখা দেবে। সাংবিধানিক সংকট হবে।
আপনি নতুন একটা প্লাটফর্মে এসেছেন দেশের জনগণের প্রতি কোনো বার্তা আছে কিনা- জানতে চাইলে তৈমূর বলেন, জনগণের কাছে বার্তা হলো, আমার জন্য দোয়া করবেন। প্রথম দায়িত্ব হলো দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এ ব্যাপারে আমি সকলের সাহায্য চাই। নেতার মুখের দিকে তাকিয়ে বক্তব্য দিতে হবে। সেই দল তৃণমূল বিএনপি হবে না।

×