ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সমাবেশের স্থান পেতে কূটনীতিকদের কাছে ধরনা

১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে নাশকতার আশঙ্কা

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে নাশকতার আশঙ্কা

১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে গুজব

১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে গুজব, অপপ্রচার ছড়ানোর বিষয়ে সাইবার ওয়ার্ল্ডে নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থা। সেইসঙ্গে সবার দৃষ্টিতে এখন ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের ভেন্যু রাজনীতি। সমাবেশের স্থান পেতে বিএনপি ধরনা দিচ্ছে বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে। ১০ ডিসেম্বর সামনে চলে এলেও আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের মধ্যকার মতবিরোধের কারণে সমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে।

নাশকতা, নৈরাজ্যের আশঙ্কা করছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে প্রায় পাঁচ হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বিশেষ অভিযান পরিচালনা জোরদারসহ যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কৌশল নির্ধারণী বৈঠক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি সম্পন্ন। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
বিএনপি প্রথমে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের জন্য নয়াপল্টন ছাড়া অন্য কোথাও সমাবেশ করবে না এমন কথা জানালেও এখন বিকল্প হিসেবে আরামবাগ সড়ক, আইডিয়াল স্কুলের সামনে, মতিঝিলের শাপলা চত্বর, জাতীয় ঈদগা মাঠ দেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণসমাবেশের অনুমতি দেওয়ার পর বিএনপির বিকল্প ভাবনার জবাবে বলে দিয়েছে যানজট, দুর্ভোগ এড়াতে কোনোভাবেই রাস্তায় সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।

এর মধ্যে টঙ্গির তুরাগ কিংবা পূর্বাচলে বিএনপিকে সমাবেশের স্থান বেছে নেওয়ার জন্য বলেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুমতি চেয়ে দুই দফা চিঠি দিলেও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণসমাবেশের অনুমতি দেয়। এই ভেন্যুকে গণসমাবেশের জন্য ‘অনিরাপদ’ আখ্যা দিয়ে বিকল্প ভেন্যুতে গণসমাবেশ করার আগ্রহ দেখায় দলটি। এই অবস্থায় সবার দৃষ্টি এখন ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকার গণসমাবেশের দিকে। কোথায় হবে বিএনপির সমাবেশ? নাকি সমাবেশই হবে না? এই ধরনের প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছে। এতে জনমনে শঙ্কা বাড়ছে।
শান্তিপূর্ণ নাকি সহিংসতা ॥ আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝেও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। সবারই জিজ্ঞাসা ওই দিন রাজধানীর পরিবেশ শান্তিপূর্ণ নাকি সহিংসতায় রূপ নেবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়া শেষ পর্যন্ত অন্য কোনো ভেন্যুতে বিএনপির গণসমাবেশের অনুমতি মিলবে কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।

এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। পুলিশও বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ কেন্দ্র করে রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকাভিত্তিক ব্লক রেইডও চালাচ্ছে। দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, পুলিশের এই অভিযানের প্রধান লক্ষ্য দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা। শেষ পর্যন্ত বিএনপির সমাবেশের স্থান নিয়ে জটিলতার অবসান না হলে কি হবে?
কূটনীতিক মহলে ধরনা ॥ বিএনপি আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকা গণসমাবেশ নিয়ে সরকারের ভূমিকাসহ দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করছে। ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী সব দূতাবাসসহ জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে  দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন ইস্যু অবহিত করা হচ্ছে।

বিশেষ করে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে কূটনীতিকদের অবহিত করা অব্যাহত আছে। এ ছাড়া সারাদেশে পুলিশের বিশেষ অভিযান, ‘গায়েবি’ মামলা, ঢাকার গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গণগ্রেপ্তার, বাসায় বাসায় তল্লাশি, গণসমাবেশের ভেন্যু প্রসঙ্গসহ নানা ইস্যু সম্পর্কে কূটনীতিকদের জানানো হচ্ছে। এসব বিষয় লিখিত আকারে জানানোর পাশাপাশি বক্তব্যে তুলে ধরবেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
নয়াপল্টনের সমাবেশের স্থান হিসেবে বিকল্প ॥ ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের ভেন্যু নিয়ে পুলিশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। নয়াপল্টন না হলেও এর আশপাশের কোনো স্থানে গণসমাবেশ করতে চায় দলটি। দলটির আগ্রহ থেকে আইডিয়াল স্কুলের সামনে, জাতীয় ঈদগা মাঠ, মতিঝিল শাপলা চত্বর, কাকরাইল, ফকিরাপুল, আরামবাগ কিংবা শান্তিনগর মোড়ের যে কোনো একটি ভেন্যুতে গণসমাবেশ করার কথা পুলিশকে জানানো হচ্ছে। এসব ভেন্যুর মধ্যে আরামবাগের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। তবে পুলিশ বিএনপিকে খোলা মাঠে গণসমাবেশের জন্য বলেছে। এর জবাবে নতুন ভেন্যুর নাম বলেছে হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগা মাঠ।
যা বলছেন সমাবেশ নিয়ে বিএনপির নেতৃবৃন্দ ॥ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম এক অনুষ্ঠানে বলেন, নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি না দিলে গোটা ঢাকায় সমাবেশ হবে; কিন্তু ঠেকানো যাবে না।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মীর্জা আব্বাস বলেছেন, একজন নিয়ে হলেও পল্টনে সমাবেশ করা হবে।
প্রশ্ন উঠেছে, অনুমতি ছাড়া বেআইনিভাবে বিএনপি নয়াপল্টনে জোরপূর্বক সমাবেশ করতে চাইলে বাধা দিবে পুলিশ। এতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ধরনের ঘটনায় দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে পুলিশকে কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করে মোকাবিলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ॥ পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রায় প্রায় ৫ হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার ১ হাজার ৩১৯ জন। পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশই বিভিন্ন মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। যে কোনো ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে রাজনৈতিক মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বিএনপি অভিযোগ করছে, গ্রেপ্তারে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যম সারির নেতাদের বেশি প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে।

শুধু ১০ ডিসেম্বর নয়, ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবসসহ নানা ধরনের কর্মসূচীতে যাতে নাশকতা ও নৈরাজ্য চালাতে না পারে সেজন্য জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারির বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গুজব ও অপপ্রচার ॥ গুজব ও অপপ্রচার ছড়ালে আইনের আওতায় আনবে আইন শৃংখলা বাহিনীর সাইবার ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থা। যে কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে গ্রেপ্তার অভিযানের পাশাপাশি অনলাইনে সাইবার প্যাট্রোলিং করছে পুলিশ। উসকানিসহ কোনো ধরনের অপরাধের চেষ্টা ও গুজব ছড়ালে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ জন্য অনলাইনে সাইবার প্যাট্রোলিং করছে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তাদের গোয়েন্দা ইউনিটগুলো অনলাইনের নজরদারি বাড়িয়েছে। অনলাইনে অপপ্রচার কিংবা গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন কোনো ধরনের স্বার্থ হাসিল করতে না পারে সে বিষয়ে তারা তৎপরতা চালাচ্ছে।
রাস্তায় অনুমতি নয় ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে খোলা মাঠ ছাড়া রাস্তাঘাটে কোনো সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আমরা বিকল্প কোনো স্থানে সমাবেশের প্রস্তাব পাইনি।

ডিএমপির কমিশনারের সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধি দলের যে আলোচনা হয়েছে সেখানে ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করার বিষয়ে নয়াপল্টন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে তৃতীয় কোনো স্থানের বিষয় আসেনি।
সাইবার ওয়ার্ল্ডে মনিটরিং ॥ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, যে কোনো ধরনের নাশকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা রুখতে অভিযানের পাশাপাশি সাইবার ওয়ার্ল্ডে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সাদা পোশাকে র‌্যাব সদস্য। সাইবার ওয়ার্ল্ডে কেউ উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে কিনা সেটিও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে র‌্যাব সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।

×