ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

জামায়াতের ২৬৩ নেতাকে খুঁজছে পুলিশ

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ১৬:১৪, ৭ অক্টোবর ২০২২

জামায়াতের ২৬৩ নেতাকে খুঁজছে পুলিশ

জামায়াতের লগো

জামায়াতে ইসলামীর ২৬৩ নেতাকে খুঁজছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় নাশকতা, হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক মামলা আছে। পুলিশের তালিকায় এসব নেতা আত্মগোপনে আছেন। পুলিশ সদর দফতর থেকে সম্প্রতি এসব জামায়াত নেতার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপার ও বিভিন্ন ইউনিট প্রধানদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। এসব জামায়াত নেতা জামিনে আছে নাকি পলাতক আছে তার খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে। তাদের কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের তালিকা তৈরির করার জন্যও বলা হয়েছে পুলিশ সদর দফতরের বার্তায়। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। 

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী নতুন করে নীল নক্সা তৈরি করে গোপন তৎপরতা শুরু করেছে দলটি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করাই হচ্ছে মুখ্য উদ্দেশ্য। গোপনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী নেতাকর্মী, ক্যাডারদের সংগঠিত ও সক্রিয় করছে দলটি। এ জন্য লক্ষাধিক কর্মী নিয়োগের ছক কষেছে তারা। বিদেশ থেকে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে এনজিওর মাধ্যমে বিরাট অঙ্কের টাকার ফান্ড সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, ছাত্র, শ্রমিকদের গড়ে ওঠা আন্দোলনে উস্কানি ও মদদ দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটানোর নীল নক্সা তৈরি করেছে জামায়াতে ইসলামী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর গোপন বৈঠক করার সময়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, রফিকুল ইসলাম খান, নির্বাহী পরিষদের সদস্য ইজ্জত উল্লাহ, মোবারক হোসেন, আবদুর রউফ, ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত এবং জামায়াতকর্মী মনিরুল ইসলাম ও আবুল কালামকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাওয়া যায়।

পুলিশের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা, ব্যক্তিসত্তা বা প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনসহ শেখ হাসিনা সরকারকে অবৈধভাবে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এমন খবর পায় পুলিশ। বৈঠকে তারা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার বৈঠক থেকে আলামত হিসেবে কিছু বই, ল্যাপটপ ও ব্যানার জব্দ করা হয়। 

ল্যাপটপটির পাসওয়ার্ড না জানায় সিআইডিতে পাঠানো হবে। ল্যাপটপে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা, ব্যক্তিসত্তা বা প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনসহ শেখ হাসিনা সরকারকে অবৈধভাবে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ হাজির হলে টের পেয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন তারা। তখন জামায়াত-শিবিরের ৯ জনকে পুলিশ আটক করা হলেও বাকি অজ্ঞাতনামা আসামিরা পালিয়ে যান।

পুলিশের তদন্তে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর উর্ধতন নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যক্রমের আড়ালে এখানে গোপনে একত্রিত হয়ে সরকারবিরোধী ও বর্তমান সরকার শেখ হাসিনাকে অবৈধভাবে উৎখাত করার জন্য শলাপরামর্শ করছিলেন। জামায়াত নেতাদের আটকের পর তাদের তল্লাশি করলে জব্দ তালিকায় রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন লিফলেট, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সম্পাদিত উগ্র মতবাদের বিভিন্ন বই-পুস্তকসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার রেজিস্টার এবং কাগজপত্র পাওয়া যায়। 

সরকারবিরোধী ও বর্তমান সরকারকে উৎখাতের গোপন ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্বীকার করেন তারা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, দেশজুড়ে জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন দলটির নেতারা। পাশাপাশি চারশোর বেশি ট্রেড ইউনিয়নের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্রদের দলে ভিড়িয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে দলটি। দলটি রয়েছে নিজেদের শিক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যও। সেখানে তরুণদের ভেড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এজন্য বিদেশ থেকে বিভিন্ন এনজিওর আড়ালে আসছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। রাজধানীর ভাটারা থেকে গ্রেফতার হওয়া দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ৯ শীর্ষ নেতা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।

গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, মিসর ও তুরস্কে থাকা দুটি দলকে এখন নিজেদের আদর্শ ভেবে আগামী নির্বাচন ঘিরে দলটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনকেন্দ্রিক নাশকতা চালাতে এখন থেকেই দল গোছানো হচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। গ্রেফতার হওয়া নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের একটি তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। 

দেশে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেছে জামায়াত। যেখানে বিদেশ থেকে ফান্ড এনে তারা মূলত দলের জন্য ব্যবহার করছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজকে তারা তাদের কর্মী ও দেশী-বিদেশী মিডিয়া ব্যবহার করে ম্লান করে অপপ্রচার চালাবে এমনও পরিকল্পনা আছে। এ জন্য বিদেশে তাদের একটি শক্তিশালী সাইবার ইউনিট রয়েছে। তারা বিদেশে বসে জামায়াতের হয়ে সরকারবিরোধী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে জামায়াত-শিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মী বিদেশে যান। তারা সেখান থেকে প্রতি মাসেই দলের জন্য বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। 

সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে জামিনে থাকা জামায়াত-শিবিরের নেতাদের তালিকা হচ্ছে। তালিকায় প্রত্যেকের নাম, বাবার নাম, বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা, পেশা, দলীয় অবস্থান, নেটওয়ার্ক, অর্থের উৎস ও মামলার রেকর্ডের বিবরণ রাখতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াত নেতাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। দলটি নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বলে তারা জানিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা ও মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পর তারা কিছুদিন চুপচাপ ছিল। এখন আবার যুদ্ধাপরাধী অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী দলটি সংগঠিত ও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরেই পলাতক। অভিযোগ আছে তারা নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করছে। অনেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও থানা পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে নিজ এলাকায় কিংবা পলাতক অবস্থায় অবস্থান করছে। এসব নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার গোপনে সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টাও করার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে অন্যান্য দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জামায়াতকেও চাঙ্গা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা পুলিশের ইউনিট প্রধানদের কাছে এসব তথ্য দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। যেসব নেতা এলাকায় আছেন অথবা যারা পলাতক আছে তাদের বিষয়ে তালিকাও তৈরি করে পাঠাতে বলা হয়েছে বার্তায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জামায়াত নেতাদের ২৬৩ জনের তালিকা থাকলেও তারা কে কিভাবে আছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তা জানে না। জামায়াতের অনেক নেতা আছেন তারা নিষক্রিয়। কিন্তু তারা এলাকায় আছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে আছেন। পুলিশের কাছে তারা আত্মগোপনে হিসেবেই থাকছেন। তাদের বিষয়ে খোঁজ নিতে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তালিকায় ২৬৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে নাশকতা, বিস্ফোরকসহ হত্যা মামলা রয়েছে। তাদের মধ্যে কারা জামিনে আছেন তাও খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। এমনকি যারা তাদের আশ্রয়-প্রশয় দিচ্ছেন বা দিয়েছেন তাদেরও তালিকা করতে বলা হয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ২০৪৮ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে জামায়াতে ইসলামী। প্রায় ৪শ’ ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেছে দলটি। এখনও বিদেশ থেকে ফান্ড এনে দলের কাজে ব্যবহার করছে। নাশকতা মামলায় অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের বিষয়ে খোঁজ নিতে বলা হয়েছে। নেতাদের ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা, পেশা, দলীয় অবস্থান, নেটওয়ার্ক, অর্থের উৎস, মামলার রেকর্ডপত্র, কোন নেতার বিরুদ্ধে কয়টি মামলায় জামিনে আছে সেই তথ্য নেয়া হচ্ছে। তবে যারা জামিনে এলাকায় আছে তাদের নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, জানা গেছে, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ২০১৩ সালে একটি রিটের আদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্ট। ২০১৮ সালে এটি গেজেট আকারে প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত-শিবির সারাদেশে ব্যাপক তাÐব চালায়। পেট্রোলে বোমা, বাসে আগুন দিয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষ হত্যার মতো অভিযোগ ওঠে দলটির বিরুদ্ধে। নির্বাচনকালে ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া, প্রিসাইডিং অফিসারকে হত্যা করার মতো কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি দলের নেতাকর্মীরা। 

পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, রাজশাহীর পুঠিয়া, বাগমারা, দুর্গাপুর, চারঘাট, বাঘা, বোয়ালিয়া, রাজপাড়া, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, টেকনাফ, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিলেটসহ রাজধানী ঢাকার বেশকিছু এলাকায় জামায়াতের প্রাধান্য বিস্তার করা আছে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে জামায়াতে ইসলামী যেসব জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এসেছিল সেসব এলাকায় জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তবে বিএনপির সঙ্গে মিলে জামায়াতে ইসলামী জ্বালাও পোড়াওসহ নাশকতা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে মামলা দায়েরের পর থেকে বর্তমানে ঘাপটি মেরে আছে।

এসআর

×