
.
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার ঘটনায় থমথমে ভাব রয়ে গেছে। কার্ফুর তৃতীয় দিন শুক্রবারেও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। আতঙ্ক বিরাজ করছে গোপালগঞ্জ শহরে।
তবে বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কার্ফু শিথিলের ঘণ্টা ছিল অনেকটা স্বস্তির। মানুষজন জুমার নামাজ আদায় করতে ও জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হয়েছেন। ২টার পর থেকে রাস্তাঘাটে মানুষের আনাগোনা আবার কমে যেতে দেখা গেছে। কার্ফুর কারণে বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যেই কার্ফুর সময় আরেক দফা বাড়িয়ে আজ শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে জেলা প্রশাসক। এদিকে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ ও ৪০০-৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। তবে চারজন নিহতের ঘটনায় তিন দিনেও মামলা হয়নি।
সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা রিক্সাচালক রমজান মুন্সি (৩২) মারা গেছেন। যৌথ বাহিনী চিরুনি অভিযান চালিয়ে নতুন করে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। হামলাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশপাশি নৌপথে টহল জোরদার করেছে নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড।
গত বুধবার গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ। দফায় দফায় সংঘর্ষ, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেদিন প্রথমে ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মদ কামরুজ্জামান। রাতেই জারি করা হয় কার্ফু। বৃহস্পতিবার কার্ফুর সময় সীমা বাড়ানো হয়। তবে মাঝখানে বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কার্ফু শিথিল ছিল। চলমান কার্ফুর সময়সীমা আরেক দফা বাড়িয়ে আজ শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে জেলা প্রশাসক।
শুক্রবার গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, চলমান কার্ফু শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
তবে গোপালগঞ্জে সহিংসতায় যে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, সেটি তৃতীয় দিনেও কাটেনি। শুক্রবারও আতঙ্কে ঘর থেকে বের হননি মানুষজন। সকাল থেকে শহরের রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা ছিল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হননি না। তবে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় বের হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ, দিনমজুর ও কিছু ভ্যানচালক। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল, তবে শহরের কাঁচাবাজার ও পাইকারি দোকানে কিছুটা ভিড় দেখা গেছে। বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কার্ফু শিথিল থাকার সময়ে রাস্তাঘাটে মানুষের কিছুটা উপস্থিতি দেখা গেছে। টানা তিনদিন লোকজন একেবারে ঘর থেকে বের হতে পারেননি।
তিনদিন ধরে লোকজন যে বদ্ধ পরিবেশে ছিল, আতঙ্কিত ছিল সেই পরিস্থিতি থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটেছে কার্ফু শিথিলের ৩ ঘণ্টা সময়ে। অনেকটা স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। এই সময়ে মানুষজন জুমার নামাজ আদায় করতে ও প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে বের হয়েছেন। সড়কে রিক্সা, অটোরিক্সা ও বাইক ছিল। তবে ২টার পর থেকে রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কমে যেতে দেখা গেছে। ঘটনার দিন থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। বৃহস্পতিবার রাতভরও চিরুনি অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। তাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘর থেকে বের হননি লোকজন।
অনেকেই জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে গেছে গোপালগঞ্জ শহর। তবে পুলিশের সার্কেল এক এএসপি জানিয়েছেন, সহিংসতার ঘটনায় বহিরাগতরা অংশ নিয়েছিল। তারা এখনো গোপালগঞ্জে রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। বহিরাগতরা যাতে বের হতে না পারে তাই কার্ফু দেওয়া হয়েছে।
তবে কার্ফুর কারণে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। গোপালগঞ্জের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও কার্ফুর কারণে তারা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ফল ও কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগে আছেন। অন্যদিকে, পোশাকসহ অন্যান্য দোকানদাররা বিক্রি বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
লঞ্চঘাট এলাকার ফল ব্যবসায়ী লোকমান হাওলাদার বলেন, কার্ফু দোকান খুলতে না পারায় ৩ দিনে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকার ফল নষ্ট হয়েছে। বুধবার সকাল ১০টার দিকে পুলিশের পরামর্শে দোকান বন্ধ করি। শুক্রবার সকালে কার্ফু শিথিল হলে ১১টার পর একবার খুলেছি। অনেক ফল নষ্ট হয়ে গেছে।
কার্ফু শিথিল হলে সকাল ১১টার পর চৌরঙ্গী এলাকায় প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারভেজ বলেন, দুই দিন বাসা থেকে বের হতে পারিনি। দরকারি কেনাকাটা ছিল। সেজন্য বের হলাম। কার্ফু শিথিল হলেও পথে লোকজন কম। সবার চোখে-মুখে এক ধরনের ভয়।
এ সময় বিভিন্ন সড়কে কিছু রিক্সা, ইজিবাইক চলাচল করতে দেখা যায়। তবে সংখ্যা ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ কম।
গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজ মোড়ে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় কয়েকজন রিক্সা চালককে। এ সময় কথা হয় তাদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে একজন সুমন শেখ। তিনি জানান, কাজ থাকলেও কার্ফুর কারণে লোকজন রাস্তায় বের হচ্ছেন না। তাই কোনো যাত্রী পাচ্ছেন না। দুপুর গড়িয়ে গেলেও মাত্র ২০০ টাকা আয় করেছেন। দিনের চাল-ডাল কি দিয়ে কিনবেন, সেই চিন্তায় তিনি।
অলিগলিতে খোলা রয়েছে ২/১টা চায়ের দোকান। কিন্তু দোকানের সামনের বেঞ্চ একেবারে ফাঁকা। কোনো ক্রেতা নেই। দোকানি হুমায়ুন কবির জানান, দুই দিন ভয়ে দোকান খোলেননি। কিন্তু শুক্রবার আর না খুলে উপায় ছিল না। কেননা, তার ছোট্ট এই দোকানের আয় দিয়েই পাঁচ সদস্যের সংসার চলে। কিন্তু দোকান খুললেও সকাল থেকে কোনো কাস্টমার নেই। ২/১ জন এসে চা-সিগারেট নিয়ে যান। দোকানে বসে চা খেতে ভয় পাচ্ছে। না জানি পুলিশ এসে আবার গ্রেপ্তার করে। এভাবে আর কতোদিন চলবে? এই প্রতিবেদককে এমন প্রশ্ন দোকানি হুমায়ূন কবিরের। যে প্রশ্নের উত্তর আর মিলেনি।
ঘটনার দিনের সংঘর্ষের চিহ্ন এখনো শহরজুড়ে। হামলাকারীদের ছোড়া ইটপাটকেল, বাঁশ, কাঠ আর ভেঙে ফেলা চেয়ারের অবশিষ্টাংশ এখনো বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সড়ক অবরোধের জন্য ফেলা রাখা গাছের গুঁড়ি সড়কের পাশে পড়ে আছে। সড়কে ইটের লালচে দাগ জানান দিচ্ছে সেদিন ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তায়নের পরিমাপ। সদর উপজেলার মাঝিঘাতী ইউনিয়নের বরিশাল-বাইপাস সড়কের ওপর শুক্রবারও একটি বড় গাছ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যেটি বুধবার এনসিপির আগমন ঠেকাতে সড়কে ফেলে রাখে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল আমিন সরদার বলেন, শহরের পরিস্থিতি এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। কার্ফু চলাকালে যেন কোনো দোকানপাট খোলা না থাকে, তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে না।
শহরে পুলিশ, এপিবিএন ও র্যাবের গাড়ি টহল দিতে দেখা গেছে। তবে নদীপথে যাতে অপরাধীরা পালিয়ে যেতে না পারে তাই নদীপথেও টহল জোরদার করেছে নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড। শুক্রবার দেখা যায়, গোপালগঞ্জ সদর থেকে মকসুদপুর টেগেরহাট পর্যন্ত নদীপথে নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের কয়েকটি স্পিড বোর্ড সাইরেন বাজিয়ে টহল দিচ্ছে। নদীতে সন্দেহভাজন নৌযানসমূহ তল্লাশি, যাত্রী পরিচয় যাচাই ও সন্দেহভাজন গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। টহল ঘিরে নদীর আশপাশের গ্রামীণ বাসিন্দাদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। না জানি যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন একাধিক বাসিন্দা।
কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ জানান, এনসিপি নেতৃবৃন্দের উপর সংঘটিত হামলার প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। এই ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে দুষ্কৃতিকারীরা নদীপথ ব্যবহার করে যেন পালিয়ে যেতে না পারে, সেই লক্ষ্যে জেলার নদীপথে বিশেষ টহল পরিচালনা করা হচ্ছে।
মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার \ পুলিশের ওপর হামলা, গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নিউটন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
গোপালগঞ্জ গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহমদ বিশ্বাস বাদী হয়ে মামলাটি করেন। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এদিকে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সকাল পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। এর মধ্যে ২৫ জনকে বৃহস্পতিবার। আর ২০ জনকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে কতজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তা জানাননি ওসি।
ওসি সাজেদুর রহমান বলেন, সদর উপজেলার উলপুর ইউনিয়নের খাটিয়াগড় চরপাড়া এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা করে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহমদ বিশ্বাস বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের জেলা শাখার সভাপতি নিউটন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সদর থানার পরিদর্শক তদন্ত আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, গত বুধবার রাতে যৌথ বাহিনী ১৪ জনকে আটক করে সদর থানায় হস্তান্তর করে। তাদের বুধবার বিকেলে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই ১৪ জনসহ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী।
গোপালগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার ১৬ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এর মধ্যে ১২ জনকে ৫৪ ধারায় আদালতে নেওয়া হয়। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
গুলিবিদ্ধ যুবকের মৃত্যু \ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সি (৩২) নামে এক যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
প্যানেল মজি