
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আমরা বেহেশতে আছি’ উক্তি জনগণের সঙ্গে তামাশা বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার দুপুরে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। ফখরুল জানান, ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে ১২ দফা পদক্ষেপ নেবে বিএনপি।
ফখরুল বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের লোডশেডিংসহ বিভিন্ন কারণে দেশের মানুষ এখন চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে, জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে তারা হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু এমন এক সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা সুখে আছি, বেহেশতে আছি’। আমি দুঃখিত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওনাকে নিয়ে কথা বলছি।
ইদানীংকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বেশির ভাগ মন্ত্রীই হাল্কা কথা বলেন। তারা জনগণের সঙ্গে পরিহাস ও তামাশা শুরু করেছেন। বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগেও এমন এমন সব উক্তি করেছেন যা দেশের মানুষের কাছে হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ওনার এ রকম পরিহাস করার কোন অধিকার নেই।
ফখরুল বলেন, সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি আর হরিলুটের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। এতদিন শতভাগ বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হলেও এখন শহরে দুই থেকে তিন ঘণ্টা এবং গ্রামাঞ্চলে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিদ্যুতের লোডশেডিংজনিত জনদুর্ভোগ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন উর্ধগতিতে দেশের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। মানুষ চরমভাবে দিশাহারা হয়ে ওঠেছে, দেয়ালে ঠেকে গেছে তাদের পিঠ। ব্যর্থতার দায় নিয়ে বর্তমান সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে জনগণের দুর্বার আন্দোলনে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
ফখরুল বলেন, বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারের দুর্নীতি, আত্মঘাতী চুক্তি ও অপরিণামদর্শী পরিকল্পনা দায়ী। বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করা হবে। ফখরুল বলেন, বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে ১২ দফা পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এর মধ্যে রয়েছে- বিদ্যুত ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশেষ আইনসহ সকল কালা কানুন বাতিল, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল করা, স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা, চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ, উৎপাদনের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিদ্যুত সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন অতি দ্রুত স্থাপন, বাপেক্স ও অন্যান্য সরকারী সংস্থার মাধ্যমে দেশীয় খনিজ ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ, দেশীয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে সম্ভাবনাময় গ্যাস/ পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনে দ্রুত ব্যবস্থা, বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের সকল দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে মোট উৎপাদনের শতকরা ৫০ ভাগ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর জ্বালানি নীতি গ্রহণ, বেইস লোড পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত উৎপাদন গড়ে তোলা, বৃহৎ বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর সংস্কার এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ঘোষিত ভিশন-২০৩০ তে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের জন্য যে কর্মসূচী প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবায়ন।
ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি কেন এমন প্রশ্ন তুলে মির্জা ফখরুল বলেন, ভারত থেকে বর্তমানে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হয়। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। ভারত থেকে বিদ্যুত কিনতে দিতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। বাংলাদেশে যখন প্রায় ৬০ শতাংশ ওভার ক্যাপাসিটি রয়েছে ঠিক সে সময় ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত আমদানি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
চুক্তির ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ভারতের আদানি গ্রুপকে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করতে হবে যা দিয়ে ৩টি পদ্মা সেতু, ৯টি কর্ণফুলী টানেল কিংবা ২ টি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে।
ফখরুল বলেন, গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে আইপিপি-এর মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদন করে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা অন্যায়ভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দশ বছর অফশোর গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগায়নি।
এমনকি বিদ্যমান গ্যাস ফিল্ডের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের মাধ্যমেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০ ভাগের অধিক গ্যাস সরবরাহ করা যেত, তাও করা হয়নি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার ইতোমধ্যে অফশোর গ্যাস উত্তোলনের মাধ্যমে দেশকে জ্বালানি সঙ্কট থেকে রক্ষা করছে।
ফখরুল বলেন, সরকার সমুদ্রবিজয় নিয়ে উৎসব করলেও অফশোরে গ্যাস উত্তোলনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এভাবে গ্যাসের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে দুর্নীতির মাধ্যমে দলীয় ব্যবসায়ীদের আমদানিকৃত এলএনজি নির্ভর প্লান্ট নির্মাণ করে অবারিত দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে সরকার। জনস্বার্থ রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব যাদের ওপর, তারাই যখন ভক্ষক হয়ে সব লুটে-পুটে খায় তখন পরিস্থিতি যা হবার তাই হচ্ছে।
আর নিরপরাধ জনগণকে খেসারত দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ভোক্তাদের টাকায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গঠন করা গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে এলএনজি আমদানিতে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে সরকার। এই টাকাটা আসলে ঋণের নামে নিয়ে নেয়া হলো আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। এটিকে বৈধ মনে করে না ভোক্তারা।
বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করেন, বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে চাহিদার অনেক বেশি পাওয়ার প্লান্টের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট চালুর ২ থেকে ৩ বছর পরই বন্ধ হওয়ার কথা থাকলে প্রয়োজন ছাড়াই এখনও চালু আছে। কিছু রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে।
বিদ্যুত উৎপাদন ছাড়াই সরকারকে এ পর্যন্ত ৯০ হাজার কোটি টাকার গচ্ছা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত ১২ বছরে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে আমরা মনে করি, ক্যাপাসিটি চার্জ অযৌক্তিক, অনৈতিক, জনস্বার্থবিরোধী এবং অপরাধ।
ফখরুল বলেন, দেশের বর্তমান জবাবদিহিহীন সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে অলস বিদ্যুত কেন্দ্র রেখেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। আর বসিয়ে বসিয়ে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে যাচ্ছে। এ অর্থ জনগণের অর্থ। এভাবে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়ে বিদ্যুত খাত দেউলিয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, অদূরদর্শী পরিকল্পনার ‘টিপ অফ দ্য আইসবার্গ’ হচ্ছে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে গেলেও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুত উৎপাদন করছে। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে চীনা ঋণে বাস্তবায়নাধীন পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রটিকে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এতদিনেও সঞ্চালন লাইনের কাজটি সম্পন্ন করা হলো না কেন? বিদ্যুত না কিনেও পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রটিকে কেন ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হলো? অনেকেই মনে করেন ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুত না কিনেও যোগসাজশে অর্থ লুটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ।