ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৮ আগস্ট ২০২৫, ২৪ শ্রাবণ ১৪৩২

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশবন: পরিবেশ, পানি ও শিল্পের নীরব রক্ষাকবচ

মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন

প্রকাশিত: ১০:২১, ৮ আগস্ট ২০২৫

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশবন: পরিবেশ, পানি ও শিল্পের নীরব রক্ষাকবচ

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তিন পার্বত্য জেলা—রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান—প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আর জীববৈচিত্র্যের এক অসাধারণ ভান্ডার। এখানকার উঁচু-নিচু পাহাড়, ঝর্ণা ও ছড়া থেকে বয়ে চলা মিষ্টি পানির প্রবাহ শুধুমাত্র স্থানীয় মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য নয়, বরং সমগ্র দেশের পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই পুরো ব্যবস্থার নেপথ্যের প্রধান নায়ক হলো বাঁশবন। বাঁশবনকে প্রায়শই কেবল একটি বনজ সম্পদ হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু এর ভূমিকা এর চেয়ে অনেক গভীর। এটি পাহাড়ি পানির উৎস রক্ষা, ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ, কার্বন শোষণ এবং স্থানীয় শিল্পকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এক নীরব রক্ষাকবচের মতো কাজ করে।

বাঁশ: একটি প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ

বাঁশ (Bamboo) মূলত ঘাস জাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ, যার বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস হলো:বোটানিক্যাল নাম: Bambusoideae (subfamily), ফ্যামিলি: Poaceae প্রজাতির সংখ্যা: বিশ্বজুড়ে প্রায় ১,৫০০ প্রজাতি, বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ৩০টির মতো।

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত কিছু বাঁশ প্রজাতি হলো: মুলি বাঁশ (Melocanna baccifera), বেথুয়া বাঁশ (Bambusa balcooa), ঝুম বাঁশ, রক্ষণ বাঁশ এবং রিং বাঁশ। এই প্রজাতিগুলো এখানকার মাটি ও জলবায়ুর সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছে। বাঁশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর গভীর এবং ছড়ানো মূলমালা, যা মাটির গভীরে প্রবেশ করে শক্তভাবে আটকে থাকে। এই মূলমালাগুলো একটি প্রাকৃতিক জাল তৈরি করে, যা মাটিকে ধরে রাখে এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে।

বাঁশবন ও মিঠা পানির উৎসের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক

পাহাড়ি অঞ্চলের ঝর্ণা, ছড়া এবং ছোট নদীগুলোর প্রধান উৎস হলো বৃষ্টির পানি। বাঁশবন এই বৃষ্টির পানিকে সরাসরি নিচে নেমে যেতে না দিয়ে ধীর গতিতে ভূগর্ভস্থ স্তরে শোষণ করতে সাহায্য করে। বাঁশের শিকড় এবং পাতার স্তর বৃষ্টির পানিকে ধীরে ধীরে ফিল্টার করে এবং ভূগর্ভে জমা করে। এই প্রক্রিয়াটি একটি বিশাল প্রাকৃতিক 'স্পঞ্জ'-এর মতো কাজ করে। এটি বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে এবং শুষ্ক মৌসুমে সেই পানিকে ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়, যা ঝর্ণা ও ছড়াগুলোতে সারা বছর পানি সরবরাহ অব্যাহত রাখে। এই প্রাকৃতিক পরিস্রাবণ প্রক্রিয়ার কারণে ঝর্ণা ও ছড়ায় সারা বছর পানি থাকে, ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস কমে, পানির গুণমান ভালো থাকে, ভূগর্ভস্থ পানি বৃদ্ধি পায়।

অতীত ও বর্তমানের চিত্র: এক বিপর্যয়ের গল্প

১৯৭০-৯০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমির একটি বিশাল অংশ জুড়ে ছিল বাঁশবন। রাঙামাটিতে প্রায় ৩০%, খাগড়াছড়িতে প্রায় ২৫% এবং বান্দরবানে আনুমানিক ২০% এলাকাজুড়ে বাঁশ বন ছিল। এই বাঁশবনগুলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনধারার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। খাদ্য, বাসস্থান, নৌকা, ঝুড়ি, এবং হস্তশিল্প সবকিছুতেই বাঁশের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। এটি কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল না, বরং তাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।

কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গবেষণা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই বাঁশবনের পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে কমে এসেছে: রাঙামাটিতে: বাঁশ বন নেমে এসেছে প্রায় ১২–১৫% এ। খাগড়াছড়িতে: বর্তমানে বাঁশ বন রয়েছে মাত্র ৮–১০%। বান্দরবানে: কিছু এলাকা যেমন লামা ও রুমায় এখনো বাঁশ বন থাকলেও তা ১৫% এর নিচে।

এই বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে কিছু প্রধান কারণ: অবাধ বাঁশ নিধন ও বাণিজ্যিক সংগ্রহ: অপরিকল্পিতভাবে বাঁশ কাটা এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বন উজাড় করা হয়েছে। জুম চাষের প্রভাব: জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দিয়ে জমি পরিষ্কার করার প্রবণতা বাঁশবনের জন্য বড় হুমকি। আগুন লাগার ফলে হাজার হাজার বাঁশ গাছ পুড়ে যায়। অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ: রাস্তাঘাট, বসতি এবং পর্যটন রিসোর্ট নির্মাণের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে, যা প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করছে। সরকারি নীতির দুর্বলতা: বন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কার্যকর নীতির অভাব এবং পুনঃরোপণ কর্মসূচির ঘাটতি এই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।

ভবিষ্যৎ সংকট: বাঁশবন না থাকলে কী হতে পারে?

যদি এই ধারা চলতে থাকে এবং বাঁশবন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়াবহ প্রাকৃতিক ও মানবিক সংকট দেখা দেবে। পানির সংকট: ঝর্ণা ও ছড়ায় সারা বছর পানি থাকবে না। শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ জলসংকট দেখা দেবে, যা স্থানীয় কৃষিকাজ ও জীবনধারণকে ব্যাহত করবে। মাটি ক্ষয় ও ভূমিধস: বাঁশবন না থাকলে বৃষ্টির পানিতে পাহাড়ের মাটি সহজেই ভেঙে যাবে, ফলে ভূমিধস বাড়বে, যা জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করবে। জীববৈচিত্র্য হ্রাস: বাঁশনির্ভর বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, কীটপতঙ্গ এবং প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হবে, যা তাদের বিলুপ্তির কারণ হতে পারে।স্থানীয় জীবিকা হুমকিতে: বাঁশনির্ভর কুটির শিল্প, নৌকা তৈরি, মাছ ধরা এবং বাঁশকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে, যা স্থানীয় জনগণের জীবিকাকে হুমকিতে ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়বে: বাঁশবন কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি হারালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাবে এবং গ্রীষ্মকাল আরও উষ্ণ হবে।

চন্দ্রঘোনা পেপার মিল: বাঁশবন নির্ভর শিল্পের করুণ ইতিহাস

১৯৪৭ দেশ বিভক্তির পর কাঁচামালের যোগানের উপর ভিত্তি করে অঞ্চলনুযায়ী  পূর্ব পাকিস্থানে যে কয়টি বৃহৎ শিল্প স্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে ১৯৫৩ সালে স্থাপিত চন্দ্রঘোনা পেপার মিল (Karnaphuli Paper Mills Ltd.) ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কাগজ কল। এটি গড়ে উঠেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঁশ বনকে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে। তৎকালীন সময়ে মিলটি বছরে ৩০,০০০ মেট্রিক টনের বেশি কাগজ উৎপাদন করত। এর প্রধান কাঁচামাল ছিল মুলি বাঁশ ও বেথুয়া বাঁশ, যা স্থানীয় বন থেকে সংগ্রহ করা হতো। এই মিলটি কেবল একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল না, বরং এটি একটি পরিবেশ-নির্ভর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। হাজার হাজার শ্রমিক, স্থানীয় বাঁশ সরবরাহকারী এবং পরিবহন কর্মীরা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু বাঁশবন উজাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রঘোনা পেপার মিল মারাত্মক কাঁচামাল সংকটে পড়ে। বর্তমানে মিলটি অনেকাংশেই আমদানিকৃত পাল্পের উপর নির্ভরশীল, যা উৎপাদন খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। 

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়

চন্দ্রঘোনা পেপার মিল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন: বাঁশ বন পুনরুদ্ধার: সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে ব্যাপক আকারে বাঁশ বন পুনরুদ্ধার কর্মসূচি চালু করতে হবে। বিশেষত বন বিভাগের উচিত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পতিত জমিতে বাঁশ রোপণ করা। স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা: পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বাঁশ চাষে উদ্বুদ্ধ করে তাদের আয়ের উৎস বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। এটি তাদের বন সংরক্ষণে আরও আগ্রহী করে তুলবে। চন্দ্রঘোনা পেপার মিল আধুনিকায়ন: মিলের পুরনো যন্ত্রপাতি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে হালনাগাদ করে উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পে রূপান্তর করতে হবে। একটি কার্যকর ETP স্থাপন করা অপরিহার্য। পরিবেশ সুরক্ষা আইনের কঠোর বাস্তবায়ন: অবাধ বাঁশ কাটা এবং পাহাড় ধ্বংস ঠেকাতে আইন প্রয়োগে কঠোরতা আনা প্রয়োজন। বন বিভাগকে আরও শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার: জুম চাষের ক্ষেত্রে আগুনের পরিবর্তে অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা যেতে পারে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ের পাদদেশে আনাচেকানাচে ঝোপঝাড় ও জঙ্গল দিয়ে প্রবাহিত পাহাড়ি ঝরনা, ছড়া এবং ঝিরিগুলো সমগ্র পার্বত্য জেলার পরিবেশ এবং প্রতিবেশ সুরক্ষায় বছরের পর বছর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। ধারণা করা হচ্ছে—বিগত ১০০ বছর আগে তিন পার্বত্য জেলায় ২ লাখ ঝরনা, ছড়া এবং ঝিরির প্রবাহ ছিল। এসব ঝরনা, ছড়া এবং ঝিরি দিয়ে পানির ধারা বহমান থাকত এবং মানুষ, পশু-পাখি ও জীবজন্তু এই পানির ধারা থেকে তৃষ্ণা  মেটাত। বিপুল সংখ্যক ঝর্ণা, ছড়া এবং ঝিরি থাকার ফলে শত বছর আগে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে ছিল হরেক রকম গাছপালা ও প্রাণী। কিন্তু এখন এসব ঝরনা, ছড়া এবং ঝিরির সংখ্যা কয়েক হাজারে নেমে এসেছে।তাই বাঁশবন শুধু একটি বনজ সম্পদ নয়, এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক ভারসাম্য, পানির উৎস এবং অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এটি পাহাড়ের নীরব রক্ষাকবচ। বাঁশ বন রক্ষা মানে শুধু প্রকৃতি নয়, শিল্প, সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা। চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের পুনরুজ্জীবন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পানির প্রবাহ—দুইয়েরই টিকে থাকা নির্ভর করছে এই অবহেলিত বনজ সম্পদের পুনরুজ্জীবনের উপর। এখনই সময় রাষ্ট্র, সমাজ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত উদ্যোগে বাঁশবন রক্ষায় এগিয়ে আসার। এই সংকট মোকাবিলা করতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।

লেখক : মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন, অর্থনীতি বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও সদস্য, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ
 

নোভা

×