ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৮ আগস্ট ২০২৫, ২৪ শ্রাবণ ১৪৩২

ডিপফেক ও ভয়েস ক্লোনিং: ডিজিটাল যুগের বিপজ্জনক মোড়

নিজস্ব সংবাদদাতা, ডেমরা,ঢাকা

প্রকাশিত: ১২:০৩, ৮ আগস্ট ২০২৫

ডিপফেক ও ভয়েস ক্লোনিং: ডিজিটাল যুগের বিপজ্জনক মোড়

ছবি: জনকণ্ঠ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি একদিকে যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করে তুলছে, অন্যদিকে সাইবার অপরাধীরাও একে পরিণত করছে ভয়ংকর এক হাতিয়ারে। বিশেষ করে, জেন প্রযুক্তির অপব্যবহার সাইবার নিরাপত্তার জন্য তৈরি করছে নতুন ও জটিল সব চ্যালেঞ্জ। জেন প্রযুক্তি ভাষা, চিত্র ও ভিডিও তৈরির ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটালেও, ডিপফেক ভিডিও বা ভুয়া অডিওর মতো কনটেন্টের মাধ্যমে এটি আজ পরিণত হয়েছে বিভ্রান্তি ও অপরাধ ছড়ানোর একটি অস্ত্রে।

জেনারেটিভ অ্যাডভারসারিয়াল নেটওয়ার্ক বা জেন হলো একটি ডিপ লার্নিং পদ্ধতি, যা ২০১৪ সালে ইয়ান গুডফেলো ও তাঁর সহকর্মীরা উদ্ভাবন করেন। এতে দুটি নিউরাল নেটওয়ার্ক—জেনারেটর ও ডিসক্রিমিনেটর—একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করে। জেনারেটর বাস্তবসম্মত নতুন ডেটা তৈরি করে, আর ডিসক্রিমিনেটর চেষ্টা করে তা আসল না নকল শনাক্ত করতে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে জেনারেটর এমন নিখুঁতভাবে নকল ডেটা তৈরি করতে শেখে, যা মানুষের বা সফটওয়্যারের পক্ষেও আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই প্রযুক্তি গেম ডিজাইন, মেডিকেল ইমেজিং ও আর্ট জেনারেশনসহ নানা ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে সেই সম্ভাবনাই এখন হুমকিতে রূপ নিচ্ছে, কারণ এটি ব্যবহার করা হচ্ছে ডিপফেক ভিডিও, ভুয়া তথ্য প্রচার ও সাইবার প্রতারণার কাজে।

ডিপফেক প্রযুক্তির সূচনা হয় ১৯৯০-এর দশকে, যখন কম্পিউটার-জেনারেটেড ইমেজারি (সিজিআই) ব্যবহার করে মানুষের মতো ছবি ও ভিডিও তৈরির প্রাথমিক চেষ্টা চলছিল। তবে এই প্রযুক্তিতে বড় ধরনের অগ্রগতি আসে জেন আবিষ্কারের পর, যা ডিপফেককে আরও বাস্তবসম্মত ও উন্নত করে তোলে। এর ফলে এখন মানুষের মুখ, কণ্ঠস্বর এবং শরীরের গতিবিধিও নিখুঁতভাবে নকল করা সম্ভব হচ্ছে।

ডিপফেক শব্দটির উৎপত্তি হয় ২০১৭ সালে, যখন রেডিট ওয়েবসাইটে এক ব্যবহারকারী "ডিপফেকস" নামে একটি সাবরেডিট তৈরি করেন। সেখানে তিনি সেলিব্রিটিদের মুখ ফেসসোয়াপ করে তৈরি করা ভিডিও শেয়ার করতেন।

আজকের দিনে জেন প্রযুক্তির অপব্যবহারে তৈরি হওয়া ডিপফেক ভিডিও ও ভয়েস ক্লোনের মাধ্যমে সাইবার অপরাধীরা খুব সহজেই যে কাউকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। তারা নতুন নতুন কৌশল তৈরি করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে ভুয়া ভিডিও বা অডিও তৈরি করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি, কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলের মতো অপরাধ করছে। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও ফিশিং ও ভয়েস ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা চালানো হচ্ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে ভুয়া খবর ছড়িয়ে সমাজে বিভাজন, গণবিক্ষোভের উস্কানি এবং মানহানিকর কর্মকাণ্ডের আশঙ্কা বাড়ছে, যা সামগ্রিকভাবে শান্তি, নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এক গভীর হুমকি হয়ে উঠছে।

ডিপফেক বা ভয়েস ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে ভুয়া কল করে ব্যাংকিং তথ্য হাতিয়ে নেওয়া, ক্রেডিট কার্ড তথ্য চুরি বা ডিজিটাল ওয়ালেট লুটের ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে ডিজিটাল পেমেন্ট ও অনলাইন লেনদেনের প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে, সেখানে এই ধরনের সাইবার অপরাধ ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

ডিপফেক প্রযুক্তির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকগুলোর একটি হলো—এর তৈরি ভুয়া কনটেন্ট অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কখনও কখনও আসল তথ্যের চেয়েও দ্রুত। এর পেছনে মূলত কাজ করে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম। ডিপফেক ভিডিও বা ভয়েস ক্লিপ সাধারণত চমকপ্রদ, আবেগউদ্রেককারী বা বিতর্কিত হয়, যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে খুব সহজেই। ফলে, ব্যবহারকারীরা যাচাই না করেই তা শেয়ার করে ফেলেন। সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম এমন কনটেন্টকে বেশি মানুষের টাইমলাইনে তুলে ধরে, কারণ এগুলোর সাথে বেশি রিঅ্যাকশন, মন্তব্য ও শেয়ার জড়িত থাকে। এভাবেই ডিপফেক কনটেন্ট ভাইরাল হয় অনেক দ্রুত, যার ফলস্বরূপ সমাজে বিভ্রান্তি, গুজব ও অস্থিরতা তৈরি হয়।

এই দ্রুতগতির ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কেবল প্রযুক্তিগত প্রতিরোধ নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস এবং দায়িত্বশীল অনলাইন আচরণ। এ জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম (যেমন: স্নোপস বা ফ্যাক্টচেক ডট ওআরজি) এবং ডিপফেক শনাক্তকরণ টুল (যেমন: মাইক্রোসফট ভিডিও অথেন্টিকেটর ও ডিপওয়্যার স্ক্যানার)। সন্দেহজনক কনটেন্ট যাচাইয়ে এসব প্রযুক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ডিজিটাল শিক্ষা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। শিক্ষার্থীদের তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা ভুয়া তথ্যের জালে না পড়ে এবং অন্যকেও সতর্ক করতে পারে।

প্রযুক্তি আমাদের বন্ধু, তবে চোখ বন্ধ করে নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজতর করলেও, এর অপব্যবহার যেন সমাজে বিশৃঙ্খলা না আনে, তা নিশ্চিত করতে হবে এখনই।

মুমু ২

×