ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

অনিরাপত্তার বেষ্টনীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর নয়

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৯:২৭, ২৬ জুলাই ২০২৫

অনিরাপত্তার বেষ্টনীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর নয়

উর্বর পলিমাটির শস্য-শ্যামল বাংলাদেশের নান্দনিক শৌর্য অঞ্চলটিকে সুরম্য নীলা নিকেতনে রূপ দিয়েছে। পাশাপাশি কত বিপর্যয়ও সামলাতে হয়েছে অষ্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর এই লড়াকু বাঙালিকে। হিত-বিপরীতের অবিমিশ্র দ্যোতনায় আপন সত্তায় টিকে থাকাও শাশ্বত বঙ্গভূমির এক অবিনাশি পালাক্রম। বিভিন্ন পণ্ডিতের লেখায় তেমন সত্য উদ্ঘটানও আবহমান বাংলার অনিন্দ্য সুন্দর সবুজ সমারোহের এক অভাবনীয় ঐতিহ্যিক ধারা। তিউনিসের আরব মনীষী ইবনে বতুতা, ফরাসি পরিব্রাজক ট্যাভাবনিয়ার মুগ্ধ বিমোহিত হয়ে কত বন্দনাই না করেছেন চিরসুন্দর বঙ্গভূমির নয়নাভিরাম নৈসর্গিক বাতাবরণের। পাকভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান পতনেও স্বাধীনচেতা লড়াকু বাঙালিদের কোনোভাবেই বশ করা সম্ভব হয়ইনি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজ নায়করা মূলত খাজনা আদায়ের বিনিময়ে লড়াকু এই স্বনির্ভর বাংলাকে কখনো নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাও করেনি। সঙ্গত কারণে শাশ্বত বাংলা তার মৌলিক ভূখণ্ডে নিরাপদ-নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করাই ছিল নিয়তির অমোঘ বিধান। আর স্বজাত্যবোধের নির্মল ধারায় চিরায়ত স্বাধীনচেতার মূল্যবোধও অক্ষয় ঐশ্বর্যের মতো যেন ছায়াসুনিবিড় শান্তির পরশে নিমগ্ন রাখতে নির্ণায়কের ভূমিকা রেখেছে। দূর-দূরান্তের বাংলাকে নিয়ে দিল্লির মসনদে আধিপত্যকারী শাসকবর্গও মাথা না ঘামানোর ইতিবৃত্ত যুগ-যুগান্তরের অনন্য নির্মাল্য তো বটেই। বিদেশি পর্যটকরা এমনও বলেছেন সুশোভিত সবুজ বাংলায় প্রবেশের বহু পথ খোলা ছিল। কিন্তু বেরুনোর পথ যেন অবরুদ্ধতার কঠিন বেষ্টনী। যার ব্যবচ্ছেদ সপ্তদশ শতাব্দীর আগ অবধি হয়নি। ধারণা করা হয় বর্বর পাহাড়ি অঞ্চলের অধিপতিরা সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক-ভারতের অনেক স্থান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনলেও বাংলাকে নাকি কোনোভাবেই সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয় উন্নত সংস্কৃতির ধারক বাঙালিদের পরাস্ত করতে গেলে অনুন্নত, বর্বর, উপজাতীয় সর্দারদের দ্বারা তা কোনোভাবেই সম্ভবও ছিল না। আবহমান বঙ্গভূমি উন্নত সভ্যতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির ধারক ছিল। ইতিহাসেই বর্ণিত আছে সভ্যতার শুভ সূচনা হয় নদী ও সমুদ্র বেষ্টিত অঞ্চলগুলোতে। তেমনি নীল নদীর তীরে অবস্থিত মিসরীয় সভ্যতাও আদিকালের নতুন সময়ের নিকটবর্তী হওয়া যেন ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবি ধারাক্রম। ব্রিটিশরাই প্রথম জাতি যারা বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি থেকে অনেক বেশি অগ্রগামী ছিল। তাই উন্নত ব্রিটিশ জাতির কাছে বাংলার পরাভূত হতে সময়ও লাগেনি। প্রথমেই শুরু হয় ব্যবসা-বাণিজ্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে ব্যবসা করতে এসে সুচতুর ও কৌশলী ইংরেজ বাংলাদেশে আস্তানা গাড়ে। বাংলার মিহি সুতার মসলিন এবং জামদানি শাড়ির বাজার ছিল ইউরেপজুড়ে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। নবাব আলীবর্দী খানের দৌহিত্র। ইংরেজরা নাকি  ব্যবসা-বাণিজ্য করার অনুমতিও পেয়েছিল তৎকালীন নবাবদের কাছ থেকে। শেষ অবধি ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ যেমন স্বাধীন বাংলার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে পরাধীনতার শৃঙ্খলবোধে ছিল একইভাবে বাংলাও শুধু স্বাধীনতা নয় আর্থিকভাবেও যে কত লোকসান গুনেছিল তাও ইতিহাসের কালো অধ্যায়। বাংলায় সৃষ্টি হয়েছিল এবং স্মরণকালের মহাদুর্ভিক্ষ¬Ñ যা ইতিহাসে বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ’৭৬-এর মন্বন্তর হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ আর বাংলার ১২৭৬ সাল ইতিহাসের তমশাচ্ছন্ন এক ক্ষতবিক্ষত অধ্যায়। আদমশুমারিতে দৃশ্যমান হয় তিন ভাগের এক ভাগ জনগোষ্ঠী অনাহারে, অর্ধাহারে মারা যায়। আবার সেই অসহনীয় এক দুঃসময়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডে হয়েছিল সাড়া জাগানো শিল্পবিপ্লব। ইংরেজ ঐতিহাসিকদেরও ধারণা ১৭৫৭ সালে ক্লাইভের হাতে বাংলার পতন না হলে ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব হতো কি না যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ। জেমস ওয়াট আবিষ্কৃত ইস্টিম ইঞ্জিনের আগে বহু উদ্ভাবন নাকি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল অর্থের জোগান দিতে না পারায়। যা পাচার করা হয়েছে বৈষয়িক সম্পদে ঐশ্বর্যশালী বাংলার কোষাগার থেকে। তার দাম যে কতভাবে গৌরবান্বিত বাঙালিকে দিতে হয়েছে তেমন সাক্ষীও ইতিহাসের আর এক পঙ্কিল অধ্যায়। যে কোনো লাগাতার স্বৈরশাসন তার একাধিপত্য আর দুঃসহ ক্ষমতার দাপটে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা আর এক মর্মান্তিক পালাক্রম তো বটেই।
৩০ লাখ শহীদানের আত্মাহুতি আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার বিনিময়ে যে স্বাধীনতার স্বাদ আমরা পেয়েছিলাম সেখানেও ইতিহাসের পঙ্কিল অধ্যায়ের নতুন করে জাগিয়ে তোলা বিকৃতির মহারণ তো বটেই। তাই নতুন বাংলাদেশ গড়ার সমূহ লক্ষ্যে যখন আপামর বাঙালি এক সুতায় গ্রথিত সেখানেও নির্বাচনের নামে প্রহসন আর ক্ষমতা দখলের জবরদস্তি বাতাবরণের অভ্যুদয় তাও দেশ আর জাতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল হয়নি। দীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসন, দুষ্কর্ম, দুর্বৃত্তায়ন আর দুরভিসন্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা আবারও অধিকারহীনতা, নিজ দেশে পরবাসী থাকার দুরাবস্থার পতিত হয়ে আর এক জগদ্দল পাথরসম শাসনকর্তার একাধিপত্যের নিগড়ে আটকে যায়। আমরা এখন ২০২৫ সালের জুলাইয়ের অন্তিম সময় পার করছি। গত বছরের এই পরিস্থিতি ছিল মারাত্মক আর ভয়াবহ এক বিক্ষুব্ধ অধ্যায়। সেখান থেকে ৫ আগস্ট অবধি কত ঝড়ঝাপটা আর শিক্ষার্থী হত্যার রক্তে পুনরায় বাংলার রাজ ও জনপদ রঞ্জিত হওয়া ইতিহাসের লোহিত সাগরের আর এক দুর্বিষহ দুর্ভোগ তো বটেই। জুলাই ফিরে এলো তার আপন মাহাত্ম্য আর সার্বিক গৌরবের অম্লান দ্যুতি নিয়ে। নবদ্যুতির আলোকিত ভুবন সামনে এসেছে ঠিকই। কিন্তু কত জঞ্জাল, অপসংস্কার, অপশাসন কাঠামোর অভ্যন্তরে গেড়ে বসেছে, তা কি সহজেই উৎপাটন আদৌ সম্ভব? প্রশ্ন থেকেই যায়। সমাজ আর অর্থনীতিবিদরা বলেন পুরানো সমাজের অভ্যন্তরে নতুন সময়ের বীজ বপন ইতিহাসেরই ক্রম বিবর্তনের অবধারিত ধারা। সময়ের ন্যায্যতা আর উপস্থিত পরিস্থিতি সামলানোর দায়বদ্ধতায় নতুন একটি অন্তর্বর্র্তী সরকার গঠন অত্যাবশ্যকই শুধু নয় জরুরিভাবে তাৎক্ষণিক কার্যক্রম চালু রাখাও প্রয়োজনীয় হিসেবে গণ্য করা সমুচিত। তবে সময় যত দীর্ঘ হচ্ছে পরিবেশ পরিস্থিতিও কেমন যেন অস্থিতিশীল হতে সময় নিচ্ছে না। ইতোমধ্যে ঘটে গেল মাইলস্টোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ করুণ পরিস্থিতি। সেটা সামলানো আর এক বিপত্তিকর অসহনীয় দুর্বিপাক। এখনো শিশু শিক্ষার্থীরা হতাহতের সংখ্যা বাড়ার দিকে। অসংখ্য পিতা-মাতা-অভিভাবক তাদের শিশু-কিশোর সন্তানদের হারিয়ে চরম দুরাবস্থায়। দুঃসময় কাঠানোর নিদারুণ এক কষ্টদায়ক পরিবেশ।

প্যানেল/মো.

×