
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম— বাংলার বিদ্রোহী চেতনার প্রতীক, সাম্যের কবি এবং অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে— এই কবিকে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম কতটা জানে, কিংবা তাঁকে আদর্শ হিসেবে কতটা গ্রহণ করছে?
দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নজরুলের কবিতা ও জীবনী পাঠ্যসূচির অংশ হলেও, তা বেশিরভাগ সময়ই নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের সীমাবদ্ধ ‘অবজেক্টিভ’ অধ্যয়নে সীমাবদ্ধ থাকে। নজরুলকে কেবল “বিদ্রোহী কবি”, “জাতীয় কবি” কিংবা “সাম্যের কবি” হিসেবে চেনানো হলেও, তাঁর বিদ্রোহের গভীর দর্শন, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন সেভাবে বিশ্লেষিত হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে নানা সেমিনার ও আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক শিক্ষকের মতে, অনেক তরুণ নজরুলের “বিদ্রোহী” কবিতার লাইন মুখস্থ বলতে পারলেও, কবির বিদ্রোহ কোন প্রেক্ষাপটে, কাদের বিরুদ্ধে এবং কোন আদর্শ নিয়ে ছিল—সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না।
বর্তমান প্রজন্ম ডিজিটাল সংস্কৃতির জগতে অভ্যস্ত। তারা অধিকাংশ সময় কাটায় ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও শর্ট ভিডিও অ্যাপে। অথচ এই মাধ্যমগুলোতে নজরুলের উপস্থিতি খুবই সীমিত। যদিও কিছু নজরুল সংগীতশিল্পী ব্যক্তিগতভাবে নজরুলের গান প্রচারে উদ্যোগ নিচ্ছেন, তবে আধুনিক উপস্থাপনার অভাবে তা তরুণদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। যেখানে রবীন্দ্রসংগীত বা আধুনিক গান নানা রিমিক্স ও সমসাময়িক রূপে পরিবেশিত হচ্ছে, সেখানে নজরুল সংগীত এখনো প্রথাগত কাঠামোয় আবদ্ধ।
নজরুল বলেছিলেন, “ধর্মের নামে হানাহানি নয়, মানুষে মানুষে বন্ধন হোক।” তাঁর লেখা, গান ও প্রবন্ধে যে অসাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণি-সচেতনতা ও মানবিক বোধ ছিল, তা আজকের তরুণদের চেতনার সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে পারত, যদি এই ভাবনাগুলো আধুনিক ভাষা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো।
তরুণদের মাঝে নজরুলের অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও আশার আলোও আছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে কিছু তরুণ নজরুল সংগীতকে কেন্দ্র করে ব্যান্ড গঠন করছে, থিয়েটার, আবৃত্তি ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে নজরুলকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরুলের কবিতা নিয়ে রিল ভিডিও তৈরি হচ্ছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত নজরুল উৎসব ও গবেষণা কার্যক্রম তরুণদের কিছুটা হলেও আকৃষ্ট করছে। তবে এসব উদ্যোগ এখনো বিচ্ছিন্ন, এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের অভাবে তা টেকসই রূপ পাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নজরুলকে তরুণদের মাঝে সত্যিকারের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নিতে হবে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ:
১. নজরুলকে আধুনিক ভাষায় উপস্থাপন: তাঁর কবিতা, গান ও প্রবন্ধকে ভিডিও এনিমেশন, শর্ট ফিল্ম, থিয়েটার ও ওয়েবসিরিজের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।
২. ডিজিটাল আর্কাইভ ও অ্যাপ: মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নজরুলের সাহিত্য ও সংগীতকে সহজভাবে তরুণদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
৩. স্কুল-কলেজে নজরুল উৎসব: প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরব্যাপী নজরুল চর্চার আয়োজন করা উচিত।
৪. আন্তর্জাতিক মঞ্চে নজরুল: তাঁর সাহিত্য ও দর্শনকে ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন করতে হবে।
কাজী নজরুল ইসলাম কেবল অতীতের কবি নন— তিনি ভবিষ্যতের চেতনা। তাঁর বিদ্রোহ ছিল না শুধু সরকারবিরোধী স্লোগান, বরং ছিল অন্যায়, বৈষম্য, সংকীর্ণতা ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে এক মহাজাগরণ। তরুণ প্রজন্ম যদি সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়, তবে নজরুল শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের অংশ নয়, বরং জীবনের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবেন।
লেখক: আজীবন সদস্য, নজরুল একাডেমি, চুরুলিয়া এবং সাবেক গবেষক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]
এম.কে.