
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি অমূল্য মৌলিক অধিকার। একজন নাগরিকের পক্ষে অন্যায়, বৈষম্য কিংবা শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো যেমন স্বাভাবিক, তেমনি সেটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কারণ গণতন্ত্রের মূল শক্তি নিহিত জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সচেতনতা এবং নির্ভীক দাবির মধ্যে। কিন্তু সেই প্রতিবাদ বা আন্দোলন যদি জনজীবনের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার পদ্ধতি ও পরিণতি নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি উদ্বেগজনক চিত্র সামনে এসেছে। যে কোনো দাবি-দাওয়া বা সমস্যাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান পন্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে সড়ক অবরোধ। শ্রমিকের বেতন বকেয়া থাকলে, কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে অনিয়ম হলে, শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি থাকলে কিংবা কোনো এলাকার স্থানীয় সংকট দেখা দিলে এসব ক্ষেত্রেই এখন সাধারণভাবে রাস্তায় বসে পড়া ও যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়াকে প্রধান কৌশল হিসেবে দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি কিংবা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতায় মানুষ হয়তো বাধ্য হয়েই পথে নামছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রতিবাদের একমাত্র জায়গা কি তবে রাস্তাই হবে? রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে প্রতিদিন লাখো মানুষ চলাচল করে। এমন বাস্তবতায় হঠাৎ কোনো রাস্তা অবরোধ হয়ে গেলে জনজীবন পুরোপুরি থমকে যায়। অ্যাম্বুলেন্স আটকে পড়ে, পরীক্ষার্থীরা সময়মতো পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে না, কর্মজীবী মানুষ পড়েন চরম দুর্ভোগে। স্লোগান, মাইক ও ব্যানারের ভিড়ে একটি শ্রেণির মানুষের দাবি হয়তো উচ্চকণ্ঠে প্রকাশিত হয়, কিন্তু অন্যদিকে সাধারণ মানুষের অসহায়তা, আতঙ্ক কিংবা ক্ষোভ আদৌ কেউ শুনছে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সড়ক অবরোধ যেন এখন এমন এক স্বাভাবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে আন্দোলনকারীদের যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তাদের পদ্ধতি হয়ে উঠছে অনাকাক্সিক্ষত ও অমানবিক। এই প্রবণতা শুধু ভোগান্তিই ডেকে আনে না, বরং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতি ও মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের অর্থ হলো কর্মঘণ্টার অপচয়, ব্যবসায়িক ক্ষতি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার। অনেক সময় এমন ঘটনাও ঘটে, যেখানে জরুরি চিকিৎসা না পেয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে জনগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকবে, তারা প্রতিবাদ করবে, দাবি জানাবে, কিন্তু তা হবে সুশৃঙ্খল, মানবিক ও বিকল্প পন্থায়। নির্দিষ্ট খোলা মাঠ, মুক্ত মঞ্চ কিংবা নির্ধারিত এলাকায় আন্দোলনের সুযোগ থাকা উচিত। এতে একদিকে মতপ্রকাশের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে, অন্যদিকে জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও বিঘ্নিত হবে না। প্রয়োজনে আইন করে সড়ক অবরোধের সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে এবং আন্দোলনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেওয়া উচিত। এখনই সময়, আন্দোলনের নামে সড়ক অবরোধের এই অমানবিক ও দুর্বিষহ সংস্কৃতি থেকে সরে আসার। হোক প্রতিবাদ, তবে তা হোক মানবিক, যুক্তিসম্মত এবং দায়িত্বশীল। যেখানে সর্বসাধারণের কল্যাণ থাকবে মুখ্য বিবেচনায়।
চট্টগ্রাম থেকে
প্যানেল