
ছবি: সংগৃহীত
কালো ও সোনালী দাগ কাটা ছোট্ট এক প্রাণী—নাম তার মৌমাছি। এটি মহান আল্লাহ তাআলার বিস্ময়কর এক সৃষ্টি। বিস্ময়কর কেন বলছি? আসলে মৌমাছি নিয়ে বিস্মিত হবার বহু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে দুই-একটির কথা শুনুন।
মৌমাছির মস্তিষ্কের আকার তিলের সমান হলেও তারা মানুষের মতো একে অপরের মুখ দেখেই এই পোকার কথা মনে রাখতে পারে। সেকেন্ডে ২০০ বার পাখা ঝাপটায় এবং ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ মাইল গতিতে ছুটে বেড়ায়—এক বাগান থেকে আরেক বাগানে ফুলের মধু সংগ্রহ করতে। আর কোন বাগানে যদি ভালো মধু পেয়ে যায়, তাহলে নেচে নেচে অন্য মৌমাছিদের সংকেত দেয়। কি অবাক লাগছে?
না, আল-কোরআনে যেসব কীটপতঙ্গের বর্ণনা এসেছে, তার মধ্যে মৌমাছি অন্যতম। কারণ, আন-নাহল বা মৌমাছি নামে আল্লাহ তাআলা পুরো একটি সূরা নাযিল করেছেন। যেই সূরায় আল্লাহ তাআলা মৌমাছির জীবন ও কর্মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন, যাতে পৃথিবীর মানুষ কীটপতঙ্গের এই জাতি থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
আল্লাহ বলেন:
"আর তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে প্রত্যাদেশ করেছেন—তুমি গৃহ নির্মাণ করো পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে। এরপর প্রত্যেক ফল হতে আহার করো। অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ পথ অনুসরণ করো। তার পেট থেকে নির্গত হয় নানা রঙের পানীয়, যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগমুক্তি। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।" (সূরা আন-নাহল)
কিন্তু প্রশ্ন হলো, চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য কী নিদর্শন বা শিক্ষা রয়েছে এই মধুকরের কাছে?
আল্লাহ মৌমাছিকে প্রত্যাদেশের কথা বলেছেন, অর্থাৎ তাদেরকে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন—তোমরা মৌচাক নির্মাণ করো পাহাড়ে, গাছের ডালে এবং মানুষের ঘরের উঁচু কোণে। বাস্তবেও আমরা দেখি, মৌমাছিরা এসব ছাড়া অন্য কোথাও ঘর বানায় না। দেখুন, কিভাবে তারা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে।
আয়াতের আরেক অংশে বলা হয়েছে—“তোমার প্রতিপালকের সহজ পথ অনুসরণ করো”। কেন আল্লাহ সহজ পথের কথা বললেন? মানুষ এখান থেকে কী শিক্ষা পাবে?
পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান পতঙ্গ বলে ধরা হয় মৌমাছিকে। কারণ, তারা যখন কোন বাগান থেকে মধু আহরণ করতে চায়, তখন সে বাগানে যাওয়ার পথ বারবার যাচাই করে—কোন পথে গেলে সময় কম লাগবে। অর্থাৎ কম সময় ব্যয় করে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্য তাদের। সেজন্যই আল্লাহ সহজ পথের কথা বলেছেন। দেখুন, এখানেও মৌমাছিরা কিভাবে আল্লাহর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে।
তাই তো কবি বলেছেন—
"মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও, নাচি নাচি দাঁড়াও না একবার ভাই
ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় যে নাই…"
মৌমাছিরা এমন একটি জাতি, যাদের রয়েছে মানুষের মতো উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিভাবে? শুনুন তাহলে—
মৌমাছিরা যখন চাক বাঁধে, প্রতিটি মৌচাকে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ ছোট ছোট কুঠরি ঘর থাকে। এই সব ঘর মিলে তারা গঠন করে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। এখানে একজন রানী মৌমাছি থাকে, সে তার মৌচাকে থাকা অন্য সব মৌমাছিকে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়।
প্রথম দায়িত্ব—বর্ডার গার্ড বা নিরাপত্তা প্রহরীর। এই মৌমাছিরা বাইরের শত্রুদের প্রবেশ রোধ করে। কেউ ঢুকতে চাইলে সবাই মিলে তাকে আক্রমণ করে, এভাবেই তারা তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
রানী মৌমাছি তিন সপ্তাহে ৬,০০০ থেকে ১২,০০০ ডিম পাড়ে। কিছু মৌমাছিকে এই শিশুদের লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরা শুধু বাচ্চাদের দেখাশোনা করে।
আর কিছু মৌমাছিকে প্রকৌশলী মৌমাছি বলা হয়। তারা ছয় কোণ বিশিষ্ট মোমের ঘর তৈরি করে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। কেউ কেউ আবার গাছপালা থেকে মোম সংগ্রহ করে প্রকৌশলীদের হাতে তুলে দেয়।
এতে বোঝা যায়, একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে সফলভাবে পরিচালনা করতে চাইলে সবার উচিত নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যদি কোনো মৌমাছি ময়লার স্তুপে বসে, পরে চাকে ফিরে আসে, তবে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মৌমাছিরা তাকে আর প্রবেশ করতে দেয় না। এমনকি রানীর নির্দেশে তাকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়। এর শিক্ষা—আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিশুদ্ধ রাখতে হলে অন্যায়কারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, নইলে অপরাধ বাড়তেই থাকবে।
মৌমাছিরা মাইলের পর মাইল উড়ে যায়, মধু সংগ্রহ করে আবার নিখুঁতভাবে বাসায় ফিরে আসে। তারা পথ হারায় না, কারণ তারা আল্লাহর দেখানো পথেই থাকে। মানুষও যদি আল্লাহর দেখানো পথে চলে, তাহলে সে পথ হারাবে না। তাই তো আমরা প্রতিদিন নামাজে বলি:
“ইহদিনা-সিরাতাল মুস্তাকিম”—আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।
আল্লাহ আরও বলেছেন—তোমরা বিভিন্ন ফল-ফুল থেকে আহার করো। মৌমাছিরা সেই অনুসারে পছন্দের ফুলে যায়, নির্যাস নেয়, কিন্তু কখনও ক্ষতি করে না। বরং নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করে।
একজন মুমিনকেও হতে হবে তেমনি—কাউকে ক্ষতি করবে না, বরং নিঃস্বার্থভাবে সবার উপকার করবে।
ফরিদ