
আয় ও সম্পদ বৈষম্য সৃষ্টি করে জাতীয় বাজেট কীভাবে ভূমিকা রেখেছে-রাখছে তা পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই বাজেট কাঠামোয় দৃষ্টি দিতে হবে। যেখানে দেখা যায় যে, স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে (১৯৭২-১৯৭৫) গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগভিত্তিক অর্থনীতির পথে হাঁটলেও মনুষ্য ও প্রকৃতিসৃষ্ট বাধার কারণে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। পরবর্তীতে সামরিক শাসন আমলে (১৯৭৫-১৯৯০) বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার প্রয়াসে সংস্কার আনা হলেও তহবিল সংকুলানের জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিতে থাকে সরকার। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৭-৭৮ সালে সামরিক সরকারের দ্বিতীয় বাজেটে কোনো প্রকার বৈধকরণ ছাড়াই কালো টাকা লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে কেবল উন্নয়ন নয়, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় বাজেটের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালে জোট সরকার দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে মৌলিক বাজেট সংস্কারের সূচনা করে প্রথমবারের মতো মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) চালু করে, যা একটি আধুনিক কর ব্যবস্থা গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিলেও বাজেট সুবিধাসমূহ ধনী ও স্বজনদের দিকে ধাবিত হয়। একই সময়ে আমদানিমূলক শুল্ক হ্রাস ও বাজার উন্মুক্ত করার নীতি গ্রহণ করা হলেও, সমাজসেবা খাতে বরাদ্দ সেই অনুপাতে বাড়েনি। রাজস্ব গঠন ও বৃহৎ প্রকল্পকেন্দ্রিক পরিকল্পনায় অধিক মনোযোগ দেওয়ায় ক্ষুদ্র কৃষক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের স্বার্থ রক্ষা কম গুরুত্ব পায়। ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে প্রবীণ ভাতা, বিধবা ও অনাথ ভাতা ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা হলেও, সেই সময়েও ধনী শ্রেণির জন্য বিশেষ সুবিধা, যেমন- বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ এবং কালো টাকা বৈধকরণের কৌশল এবং ধনিক শ্রেণি ও অঞ্চলমুখী উন্নয়ন প্রকল্প-অবকাঠামো জোর পায়। জোট সরকার রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে ধনীদের খুশি করার করনীতি নানা ছাড়-নিস্তারের জালে আবদ্ধ ছিল। যা ২০০৯ সালের পর দীর্ঘ এককদলীয় শাসনামলে সংসদে দাঁড়িয়েই ‘ব্যবসায়ীদের জন্য বাজেট ও আর্থিক নীতিপ্রণয়ন’ হয়েছে বলে বারবার ঘোষণা দেওয়া হয়। জ্বালানি-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং বাজেটের বড় বড় অংশ ঋণ করে সেতু-ফ্লাইওভার ইত্যাদিতে ব্যয় হয়। কর-রাজস্বের অর্জিত আয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রতিরক্ষা-আইনশৃঙ্খলা এবং বড় ব্যবসায়ীদের ছাড় ও প্রণোদনায় দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-আবাসনের মতো মৌলিক অধিকার-চাহিদা পূরণ ক্রমাগত সংকুচিত হয় এবং সামাজিক খাতের বরাদ্দ প্রয়োজন ও তুল্যবিচারে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি দূরের কথা, প্রাপ্ত বরাদ্দও নানা ছলে-কৌশলে আর্থিকভাবে সক্ষমদের দিকে ধাবিত করা হয়। এমনকি ২০১০-এর দশকভর একাধিক বাজেটে ১০ শতাংশ হারে সরকারি তহবিলে অর্থ জমা না দিয়েই ঘুষ-দুর্নীতি-অপকর্মে অর্জিত কালো টাকা জমি, স্টক ও ব্যাংকে বিনিয়োগের সুযোগ বৈধ করা হয়। অর্থাৎ ধনী শ্রেণির সম্পদের বৈধতা প্রদান করে কর ফাঁকির সুযোগ বহাল রেখে সরকার সাম্য প্রতিষ্ঠায় অস্বীকৃতি জানায়। ফলে সামগ্রিক গড় আয় বৃদ্ধি পেলেও দেশের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির আয়ের অংশ ক্রমশ বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায় শীর্ষ ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী দেশে মোট আয়ের শতকরা ৪১ ভাগ ভোগ করে, যেখানে নিম্ন ১০ শতাংশ পায় মাত্র ১.৩ শতাংশ। দীর্ঘস্থায়ী আয় বৈষম্য সম্পদ বৈষম্যকে আরও কঠিন করে তোলে। যারা কম আয় করে, তাদের পক্ষে সম্পদ অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে সামাজিক গতিশীলতা সীমিত হয়ে যায় এবং দরিদ্র মানুষ কখনই উল্লেখযোগ্য সম্পদের মালিক হতে পারে না। বাংলাদেশে উত্তরাধিকার করের অনুপস্থিতি এই অবস্থাকে আরও প্রকট করে তোলে। যেখানে অনেক উন্নত দেশে এ ধরনের কর সম্পদ বৈষম্য কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যদিও বাংলাদেশে সম্পদের ওপর একটি নামমাত্র সারচার্জ আরোপ করা হয়, তবে এর কার্যকারিতা খুবই সীমিত।
বৈষম্য ও দারিদ্র্য বিষয়ে সরকারের ৫৪ বছরের বার্ষিক বাজেটের সাধারণ নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হলে ১৯৭৩-২০০৫ সাল পর্যন্ত খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতির ভিত্তিতে দুই ধরনের দরিদ্র খানার তথ্য যথা নিরঙ্কুশ দরিদ্র ও চরম-হতদরিদ্র খানা এবং ১৯৯১-২০২২ সাল পর্যন্ত খানার মৌলিক চাহিদা পদ্ধতির ভিত্তিতে দুধরনের দরিদ্র খানার তথ্য যথা উচ্চ দারিদ্র্যসীমার নিচের খানা এবং নিম্নদারিদ্র্য সীমার নিচের খানার তথ্য প্রয়োজন। তবে সত্যিকার তথ্য ও প্রবণতা জানতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মৌলিক চাহিদা পদ্ধতির ভিত্তিতে খানার দারিদ্র্য হার ও খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতিভিত্তিক খানার দারিদ্র্য হার জানা, যা ইচ্ছে করেই রাষ্ট্র লুকিয়ে রাখে। অথচ খানার আয়-ব্যয় জরিপে সরকার প্রকৃত দারিদ্র্য হারসংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য ঠিকই সংগ্রহ করে, কিন্তু প্রকাশ করে না। এমনেিতই সংজ্ঞায়নের চাতুরিতে সরকারি পরিসংখ্যানের দরিদ্র-দারিদ্র্যসংশ্লিষ্ট হার সঠিক নয়, তার ওপরে তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়। এই প্রবণতার পেছনে কাজ করে ধনীদের আরও ধনী করার রাষ্ট্রীয় পরিচালনা নীতি-দর্শন।
দীর্ঘকাল ধরে জাতীয় বাজেটের পরিকল্পনায় মূলত জিডিপি-উন্নয়ন এবং বড় প্রকল্পের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ঘাটতির হিসাব মেটাতে করহার কম রাখা, বাজেটের একটি বড় অংশ ঋণের ওপর নির্ভরশীল রাখা এবং অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ প্রদানের কারণে সরাসরি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগভিত্তিক অর্থনীতির পথে হাঁটলেও পরবর্তীতে বেসরকারি খাতকে উদ্দীপিত করার প্রয়াসে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়, যা সামাজিক সাম্য বিধানে বাজেটের অবদানকে সীমিত করে। ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা হলেও সমাজসেবা খাতে বরাদ্দ সেই অনুপাতে বাড়েনি। রাজস্ব গঠন ও বড় প্রকল্পকেন্দ্রিক পরিকল্পনায় বেশি মনোযোগ দেওয়ায় ক্ষুদ্র কৃষক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু হলেও ধনী শ্রেণির জন্য বিশেষ সুবিধা এবং কালো টাকা বৈধকরণ কৌশল অব্যাহত ছিল। দীর্ঘ একক দলীয় শাসনামলে জ্বালানি-বিদ্যুৎ, অবকাঠামোর বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সামাজিক খাতে বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। বরং করনীতিতে আবার আয়-গোপন করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়। যা ধনী-সম্পদের বৈধীকরণ করে কর ফাঁকির সুযোগ বহাল রাখে এবং সরকারের আদর্শে সাম্য আনতে অপারগতার পরিচয় দেয়। ফলে সামগ্রিক গড় আয় বাড়লেও দেশের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির আয়ের অংশ ক্রমশ বেড়েছে এবং নিম্নবিত্তের অংশ খুবই সামান্য। সরকারি রাজস্ব আহরণের দুর্বল কাঠামোও বৈষম্য বাড়িয়েছে। কর-জিডিপি অনুপাত দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমুখী, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় সর্বনিম্ন। রাজস্ব জোগাড়ের এই দুর্বলতা বোঝায় বাজেটের ঘাটতি কেবল ঋণ এবং সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো করের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অনিয়মপূর্ণ লেনদেন এবং রূপান্তরবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে এতদিন বড় আয়ের লোকেরা কর ফাঁকি দিয়ে আসছে। যার ফলে সরকার বিকল্প না পেয়ে বাড়তি করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর চাপাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং এ খাতে বরাদ্দের অবস্থাও হতাশাজনক। বরাদ্দের একটি বড় অংশ পেনশন, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং কৃষি ভর্তুকির মতো খাতে চলে যায়, যা সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন সহায়ক নয়। অর্থনীতিতে কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো ঘাটতি দেখা যায়। কৃষি খাতে বরাদ্দ হ্রাস পাওয়ায় এবং সাশ্রয়ী মূল্যের কৃষি উপকরণের অভাবে কৃষকরা সংকটের মুখে পড়ে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বরাদ্দ অপ্রতুল, যা মানবসম্পদ উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে শিল্প, পরিবহন ও অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির ফলে অল্পসংখ্যক বৃহৎ ব্যবসায়ী ও নির্মাণ সংস্থা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন বাড়েনি।
তিন দশকের বর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়কালে ৭৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীই দরিদ্র এবং ১৪ শতাংশ মূলত অতীতের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি-উদ্ভূত। একই সময়ে মধ্য-মধ্যবিত্ত জনসংখ্যার পরিমাণ বেড়েছে ২ কোটি ৭৬ লক্ষ। মধ্য-মধ্যবিত্তে বর্ধমান শতকরা ৬১ শতাংশ জনসংখ্যা গঠিত হয়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত গ্রুপ বৃদ্ধির কারণে। জনসংখ্যার এই প্রবণতা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে উপরে উঠতে দেয় না। আর মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিম্ন্ন-মধ্যবিত্তের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। এই অবস্থা সৃষ্টিতে জাতীয় সংসদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে উপস্থাপিত জাতীয় বাজেট মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। ফলে বিগত ৩০ বছরে যখন মধ্যবিত্ত শ্র্রেণির মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, ঠিক একই সময়ে নিম্ন-মধ্যবিত্তের বৃদ্ধির হার ৪৭ শতাংশ। আর অতীতের নিম্ন-মধ্যবিত্তদের এক বৃহৎ অংশ দরিদ্রের সমাজে ঢুবে গেছে। বিত্তের এই অধঃপতনমুখী যাত্রা দেখে নির্মোহ যে কোনো মানুষই নিশ্চয় নির্দ্বিধায় বলবে, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরের বাজেট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ‘আয় ও সম্পদ বৈষম্য বৃদ্ধির কারিগর’ পরীক্ষায় সফলভাবে পাস করেছে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল