
প্রাচীন বিশ্বের সপ্ত আশ্চর্যের একটি ছিল হ্যালিকারনাসাসের মৌসলিয়াম, যা বর্তমান তুরস্কের বোড্রাম শহরে অবস্থিত। এই জাঁকজমকপূর্ণ সমাধিসৌধটি কেবল একটি স্থাপত্য নিদর্শনই ছিল না, এটি ছিল কারিয়ার শাসক মাউসোলুস ও তার স্ত্রী-সহোদরা আর্টেমিসিয়া ২-এর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং তাদের ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৩ থেকে ৩৫০ অব্দের মধ্যে নির্মিত এই বিশাল কাঠামোটি তার অনবদ্য নকশা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে। উল্লেখযোগ্যভাবে, “মৌসলিয়াম” শব্দটি মাউসোলুসের নাম থেকেই এসেছে, যা পরবর্তীকালে যেকোনো বিশাল ও অলংকৃত সমাধির সমার্থক হয়ে ওঠে।
মৌসলিয়ামটি নির্মাণ করেন গ্রীক স্থপতি স্যাটিরোস ও প্রিনের পাইথিউস। এর উচ্চতা ছিল প্রায় ৪৫ মিটার (১৪৮ ফুট) এবং চারটি পাশে ছিল চারজন বিশিষ্ট গ্রীক ভাস্করের—লিওচারেস, ব্রায়াক্সিস, পারোসের স্কোপাস ও টিমোথিউস—নকশা করা চমৎকার ভাস্কর্য। এই স্থাপত্যে গ্রীক, পারসিক ও স্থানীয় কারিয়ান সংস্কৃতির এক অনবদ্য সমন্বয় দেখা যায়। একটি উঁচু পডিয়ামের ওপর নির্মিত এই সমাধিতে ছিল আইওনিক স্তম্ভের সারি, যার উপরে ছিল ২৪ ধাপবিশিষ্ট পিরামিড আকৃতির ছাদ। সর্বোচ্চ চূড়ায় স্থাপন করা হয়েছিল একটি ঘোড়ার রথসহ বিশাল ভাস্কর্য, যা সম্ভবত স্বয়ং পাইথিউস নির্মাণ করেছিলেন। পুরো স্থাপনাটির চারপাশে ছিল যুদ্ধ, শিকার ও পৌরাণিক কাহিনির ওপর ভিত্তি করে তৈরি অসংখ্য উত্কীর্ণ দৃশ্য ও ভাস্কর্য। ধারণা করা হয়, এতে প্রায় ৪০০টি ফ্রি-স্ট্যান্ডিং ভাস্কর্য ছিল।
মাউসোলুস ছিলেন কারিয়ার একজন প্রভাবশালী পারসিক সত্রাপ, যিনি তার রাজধানী মিলাস থেকে হ্যালিকারনাসাসে স্থানান্তর করেন এবং এই নগরকে রাজ্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেন। তার ও আর্টেমিসিয়ার শাসনামলে কারিয়ার উন্নতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ছিল অভূতপূর্ব। মৌসলিয়ামটি কেবল একটি সমাধি নয়, বরং ছিল মাউসোলুসের প্রজ্ঞা, প্রতিপত্তি ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কসুলভ পরিকল্পনার স্থায়ী প্রতিচ্ছবি। প্রাচীন লেখক প্লিনি দ্য এল্ডার তার বিবরণে এই সমাধিসৌধের বিশালতা ও সৌন্দর্যের বিশদ বর্ণনা করেছেন, যা এর তৎকালীন মাহাত্ম্য তুলে ধরে।
দুর্ভাগ্যবশত, মৌসলিয়ামটি ১২ থেকে ১৫ শতকের মধ্যে ধারাবাহিক ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এটি ছিল সপ্ত আশ্চর্যের মধ্যে শেষ ধ্বংসপ্রাপ্ত নিদর্শন। পরবর্তীতে, ১৫ শতকে রোডসের সেন্ট জনের নাইটরা বোড্রামের দুর্গ নির্মাণে মৌসলিয়ামের পাথর পুনর্ব্যবহার করেন। ১৯ শতকে স্যার চার্লস থমাস নিউটনের নেতৃত্বে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়, যা প্রাচীন বর্ণনাগুলোর সত্যতাকে নিশ্চিত করে। তার খননকার্যে বহু মূল্যবান ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের উপাদান উদ্ধার করা হয়, যেগুলো বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এবং ডিজিটাল পুনর্গঠনের মাধ্যমে মৌসলিয়ামের আসল রূপ ও নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে।
হ্যালিকারনাসাসের মৌসলিয়াম মানব সভ্যতার স্থাপত্য ও সংস্কৃতির এক অবিস্মরণীয় নিদর্শন। এটি প্রমাণ করে যে, প্রাচীন যুগে মানুষ কেমন অসাধারণ শিল্পকর্ম নির্মাণে সক্ষম ছিল। যদিও এর মূল কাঠামো আজ আর নেই, তবে এর গল্প ও ধ্বংসাবশেষ এখনো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এক হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় অতীত ও প্রাচীন বিশ্বের বিস্ময়কর সৃষ্টিকে।
রাজু