ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রোডসের কলসাস: প্রাচীন বিশ্বের ধ্বংসপ্রাপ্ত এক আশ্চর্য

মো. আতিকুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ২২:২৩, ৩১ মে ২০২৫

রোডসের কলসাস: প্রাচীন বিশ্বের ধ্বংসপ্রাপ্ত এক আশ্চর্য

প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যগুলোর কথা উঠলেই চোখে ভেসে ওঠে গিজার পিরামিড কিংবা আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘরের দৃশ্য। সেই বিস্ময়গুলোর পাশে স্থান করে নিয়েছিল আরেকটি অনন্য সৃষ্টি—রোডসের কলসাস। স্বল্পকাল স্থায়ী হলেও এই বিশাল মূর্তিটি মানব ইতিহাসে অমলিন এক ছাপ রেখে গেছে। গ্রীসের রোডস দ্বীপে সূর্যদেব হেলিওসের সম্মানে নির্মিত এই ভাস্কর্য ছিল বিজয়, কৃতজ্ঞতা এবং আত্মমর্যাদার এক অদ্বিতীয় প্রতীক।

কলসাসের পেছনের গল্প শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে, যখন ম্যাসেডোনিয়ার রাজা অ্যান্টিগোনাসের পুত্র ডেমেট্রিয়াস পোলিওরসেটেস বিশাল বাহিনী নিয়ে রোডস শহর অবরোধ করেন। একটানা এক বছর সেই অবরোধ রোডিয়ানরা অদম্য সাহসে প্রতিহত করে। ডেমেট্রিয়াস যখন পরাজিত হয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেন, তিনি রেখে যান বিপুল অস্ত্র ও যুদ্ধসামগ্রী। সেগুলো বিক্রি করে অর্জিত অর্থেই রোডিয়ানরা গড়ে তোলে হেলিওসের সেই মহান ভাস্কর্য—রোডসের কলসাস।

এই বিশাল শিল্পকর্ম নির্মাণের দায়িত্ব পান চারেস অফ লিন্ডোস নামের এক খ্যাতনামা ভাস্কর। প্রায় বারো বছর ধরে চলা নির্মাণকাজ শেষ হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৮০ অব্দে। কলসাস ছিল প্রায় ৩৩ থেকে ৩৫ মিটার (১০৮ থেকে ১১৪ ফুট) উচ্চতা বিশিষ্ট—তৎকালীন সময়ের এক প্রকৌশল বিস্ময়। এর অভ্যন্তরে ছিল লোহার কাঠামো ও পাথরের ভিত্তি, যার গায়ে বসানো হয়েছিল ব্রোঞ্জের পাত। অনেকেই মনে করেন, মূর্তিটি বন্দরের দু’পাশে দাঁড়িয়ে প্রবেশপথ ঢেকে রাখত, কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে—এটি আসলে মান্দ্রাকি বন্দরের এক পাশে মজবুতভাবে স্থাপিত ছিল।

কিন্তু এই গৌরবের স্থায়িত্ব ছিল খুবই স্বল্প। নির্মাণের মাত্র ৫৪ বছর পর, খ্রিস্টপূর্ব ২২৬ অব্দে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে কলসাস ভেঙে পড়ে, হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিশাল মূর্তিটির ধ্বংসাবশেষ বন্দরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এক জনশ্রুতি অনুসারে, ওরাকলের নির্দেশে রোডিয়ানরা এটিকে পুনর্নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং মিশরের রাজা তৃতীয় টলেমির প্রস্তাবিত অর্থসাহায্যও প্রত্যাখ্যান করে।

এই ধ্বংসাবশেষ প্রায় আট শতাব্দী ধরে রোডসে পড়ে ছিল—যেন ইতিহাস নিজেই সেখানে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল। শেষপর্যন্ত ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে আরব বাহিনী রোডস দখল করে এবং ভগ্নাংশগুলো স্ক্র্যাপ ধাতু হিসেবে এক ইহুদি বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। কিংবদন্তি বলে, এই ধাতু পরিবহনে প্রায় ৯০০টি উট ব্যবহার করা হয়েছিল।

আজ আর রোডসের কলসাসের কোনো ভৌত চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। তবুও, এটি প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় এক অনড় স্থান দখল করে রেখেছে। কলসাস শুধু একটি মূর্তি ছিল না—এটি ছিল মানব জাতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সৃজনশীলতা ও প্রকৃতির প্রতাপের সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি। নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অফ লিবার্টি থেকে শুরু করে বহু আধুনিক স্থাপত্যেই এর ছায়া দেখা যায়। এমনকি "কলসাস" শব্দটিও আজ বিশ্বজুড়ে বিশালতা ও মহিমার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে রোডসে এই কলসাস পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক চললেও প্রশ্ন রয়ে যায়—এটি কি ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, নাকি আধুনিকতার নামান্তর এক আত্মঅহংকার?

রোডসের কলসাস শুধু একটি কাঠামো ছিল না—এটি ছিল সময়ের ওপর মানুষের আধিপত্য স্থাপনের এক প্রচেষ্টা, যা আজও আমাদের কল্পনার রাজ্যে অক্ষয় হয়ে আছে। বাস্তবে না থাকলেও, কল্পনায় সে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে—এক জীবন্ত স্মারক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ইতিহাস কেবল পাথরে খোদাই নয়; তা অনুভব, বিস্ময় আর চিরন্তন প্রেরণারও গল্প।

রাজু

×