ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কালের সাক্ষী জাহাজঘাটা নৌদুর্গ

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৪:৩২, ৩১ মে ২০২৫

কালের সাক্ষী জাহাজঘাটা নৌদুর্গ

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার খানপুর গ্রামে অবস্থিত জাহাজঘাটা নৌদুর্গ এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে আজও টিকে আছে। স্থানীয়দের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় এর গৌরবময় অতীত। শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার উত্তরে যমুনা-ইছামতি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত এই দুর্গটি নির্মাণ করেন বাংলার বিখ্যাত যোদ্ধা ও রাজা প্রতাপাদিত্য। মুগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি এই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নৌদুর্গ নির্মাণ করেন।

জাহাজঘাটা ছিল প্রতাপাদিত্যের প্রধান নৌঘাঁটি ও প্রশাসনিক কার্যালয়। এখান থেকেই তিনি তার নৌবাহিনী পরিচালনা করতেন। দুর্গটি ছিল তিনতলা বিশিষ্ট একটি সুদৃঢ় স্থাপনা। সময়ের সাথে সাথে নিচের দুই তলা মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে। এখনও দৃশ্যমান উপরের তলাটি ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধারণা করা হয়, ১৬ শতকের শেষ দশকে প্রতাপাদিত্য এই দুর্গ নির্মাণ করেন।

নৌদুর্গটির কাঠামো এখন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। লবণাক্ততা ও প্রাকৃতিক ক্ষয়ের কারণে ভবনের চুন-সুরকি ভেঙে পড়ছে। তবে এখনো বোঝা যায় এর ভেতরের কাঠামোগত বিন্যাস। দীর্ঘায়ত ভবনটির ভেতরে ছয়টি কক্ষ রয়েছে—অফিস, মালখানা, শয়নকক্ষ ও স্নানাগারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছিল এসব কক্ষ। একাংশে কোনো জানালার অস্তিত্ব নেই, যা আক্রমণ ঠেকানোর একটি কৌশল হতে পারে। ছাদের গম্বুজে ছিল বড় বড় ছিদ্র, যাতে স্বচ্ছ কাচ বা স্ফটিক বসানো ছিল। সূর্যের আলো ওই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে পুরো ভবন আলোকিত করত, যা নির্মাণশৈলীর অনন্য উদাহরণ।

জাহাজঘাটার পাশেই অবস্থিত দুদলী গ্রাম, যা রাজ্যের নৌসেনাপতি ডুডলির নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এখানে ছিল রাজা প্রতাপাদিত্যের নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ ও সংরক্ষণের ডকইয়ার্ড। যুদ্ধের সময় নৌবহরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এটি।

অতীতের এই গৌরব আজ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বহু দর্শনার্থী এখানে আসেন দুর্গের ইতিহাস জানতে ও তা চোখের সামনে দেখতে। অনেকেই মনে করেন, সংরক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে জাহাজঘাটা নৌদুর্গ হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র এবং বাংলার হারিয়ে যাওয়া নৌ-ঐতিহ্যের প্রতীক।

কালিগঞ্জ উপজেলা থেকে শ্যামনগরের পথে মৌতলা পার হয়ে খানপুর গ্রামের পথে একটু এগোলেই চোখে পড়ে এই স্থাপনাটি। অবহেলার ছায়া থেকে মুক্তি পেলে এটি হতে পারে ইতিহাস সচেতনতায় অনুপ্রেরণার একটি নতুন দিগন্ত।

সানজানা

×