
.
এ বছর এক ব্যতিক্রমী বাজেট দিতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। শুধু বাজেটের আকারই নয়, উপস্থাপন থেকে শুরু করে বাজেটের বিষয়বস্তুতেও ব্যতিক্রমের ছাপ দেখা যাবে। সবকিছু মিলিয়ে দেশের মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা দেখা যাবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে।
এই প্রথম বাংলাদেশের নতুন বাজেটের আকার ছোট হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি বছরই বেড়েছে নতুন বাজেটের আকার। কিন্তু কম রাজস্ব আদায় এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত বাজেটে কমানো হচ্ছে সরকারের বার্ষিক ব্যয়। আবার প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়লেও বছর শেষে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ফলে বাস্তবায়নযোগ্য করতেই কমানো হচ্ছে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার। তবে আকার ছোট হলেও মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি নজর দেওয়া হবে।
এই প্রথম বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে সোমবার বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে আজ সোমবার ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এই বাজেট ঘোষণা করবেন। কেননা ৫ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত থাকছে ঈদের ছুটি। আর বাজেট ঘোষণার পরদিন রেওয়াজ মেনে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন অর্থ উপদেষ্টা। এটি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোবেল বিজয়ী প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আগামী অর্থবছরেরর বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। মূল বাজেটের আকার কমার কারণে ছোট হচ্ছে উন্নয়ন বাজেটও। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এই কাটছাঁটের মধ্যেও কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কিছুটা বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সরকারের অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় অনুমোদন করা হয়েছে।
প্রতি বছর জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করলেও এবার গতানুগতিক প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রম কিছু করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) স্টুডিও থেকে বিকেল ৩টায় সরাসরি ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা। এটি তার নিজের এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট।
সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে অনুমোদন হবে আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। এরপর এতে সই করবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
অনুমোদনের পর দুপুরে বাজেট ডকুমেন্টস নিয়ে রামপুরার বিটিভি ভবনে যাবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সেখান থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি বিকেল ৩টায় ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট বক্তৃতা প্রচার করা হবে।
একই সঙ্গে সোমবার ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা সমাপ্তির পর পরই এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টস অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটে দেখা যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্য শোনা যাবে। এ জন্য ইতোমধ্যেই ওয়েবসাইটিকে বিটিভির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এখন এতে টেস্ট স্ট্রিমিং (ওয়েব) হিসেবে বিটিভির প্রোগ্রামগুলো দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া জাতীয় বাজেট বক্তৃতা বিটিভি থেকে ফিড নিয়ে অন্য সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতারে একই সময়ে সম্প্রচার করবে।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। তবে বাজেট ঘোষণার পর প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর নাগরিকদের নিকট মতামত চাইবে অর্থ মন্ত্রণালয়। মতামতের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত করা হবে। পরবর্তীতে আগামী ২৩ জুনের পর যে কোনো একদিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে তা আগামী এক জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে।
নতুন বছরের বাজেট ছোট হওয়ার ব্যাখ্যাও দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ব্যয় সঙ্কোচনের মূল কারণ আইএমএফের শর্ত পূরণ, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া এবং রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ। নতুন বাজেটের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে ১০টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এতে উচ্চাভিলাষী কোনো লক্ষ্যমাত্রা থাকবে না।
রাজস্বনীতির সঙ্গে মুদ্রানীতির সমন্বয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাজেটে সংস্কার কমিশন ও টাস্কফোর্স রিপোর্টের সুপারিশগুলো প্রতিফলিত হবে। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সহায়তা পেতে বাজেট ঘাটতি কমানো, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
রাজস্ব বাজেটের ৫৭ শতাংশ বেতন, ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে। শুধু ভাতা ও বেতন বাবদ ৮২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১০ থেকে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা চালু হতে পারে।
বাজেটের অর্থনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ অর্থনীতির সম্প্রসারণ। নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ ছাড়া আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় সেই ঘোষণাও দেবেন। চলতি অর্থবছরেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে চলতি বছর এপ্রিলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।
প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটে পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ধরা হচ্ছে প্রায় ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রায় ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন খাত থেকে কর অব্যাহতি কমিয়ে।
সামাজিক নিরাপত্তা নতুন যুক্ত হচ্ছে ৬ লাখ ॥ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে আরও ৬ লাখ ২৪ হাজার সুবিধাভোগী। একই সঙ্গে আসন্ন বাজেটে সব ধরনের ভাতা সর্বনি¤œ ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ একশ’ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ থেকে ৯০০ টাকায় উন্নীত করা হচ্ছে। এতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।
বাজেট হবে সময়োপযোগী এবং বাস্তবায়নযোগ্য ॥ প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট হবে সময়োপযোগী, বাস্তবভিত্তিক এবং বাস্তবায়নযোগ্য। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট প্রণয়নের সময় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি এই বাজেটকে (২০২৫-২৬) ছোট বলব না, তবে এটি অবশ্যই বাস্তবায়নযোগ্য এবং সময়োপযোগী হবে। এটি সময়োপযোগী হবে কারণ এতে মূল্যস্ফীতি, বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজস্ব আহরণ এসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। আমরা সব দিক বিবেচনা করেই বাস্তবভিত্তিক বাজেট তৈরি করেছি।’
উল্লেখ্য, চলতি ২০২৫-২৫ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার মূল বাজেট ঘোষণা করেছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পরে তা সংশোধন করে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার মধ্যে সীমিত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা করা হয়েছিল।