
.
বাংলাদেশকে ম্যানুফেকচারিং হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। আমাদের ডায়ন্যামিক জনশক্তি বিনিয়োগকারীদের জন্য আদর্শ গন্তব্য হিসেবে উপনীত হয়েছে। তারপরও আমরা যুগ যুগ ধরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছি।
রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের (বিডা) কার্যালয়ে চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বেশকিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হলেও সেগুলো খালি পড়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে সেখানে গবাদিপশু চরানোর কাজ হতো। ব্যাপক আকারে দুর্নীতি, স্বৈরাচারতন্ত্র বিনিয়োগকারীদের বিমুখ করেছে। লাখ লাখ তরুণের নেতৃত্বে হওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থান সেই দিনগুলোর ইতি টেনেছে। তারা নতুন বাংলাদেশ গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ইতিহাসে আমরা এই সুযোগ পেয়েছি। সুতরাং অনুগ্রহ করে আপনারা এই ইতিহাসের অংশ হন। আমাদের সঙ্গে এই দেশের ইতিহাসের অংশ হন।
সম্মেলনে চীনের একশ’ কোম্পানির প্রায় ২৫০ বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী অংশগ্রহণ
করেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়ান ওয়েন বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশেক মাহমুদ বিন হারুন।
সম্প্রতি তাঁর চীন সফরের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বেজিং সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্টকে চীনা কোম্পানিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কারণ, আমরা এই দেশকে ম্যানুফেকচারিং খাত এবং অর্থনীতির একটা হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। চীনের প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি আশা করিনি, এত দ্রুত এত বড় একটা প্রতিনিধিদল দেশে আসবে।
তিনি বলেন, ‘চীনা কোম্পানিরা বিশ্বের প্রধান ম্যানুফেকচারিং প্রতিষ্ঠান এবং আমরা আপনাদের অংশীদার হতে চাই। আপনাদের বড় আকারে বিনিয়োগ আমাদের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন করতে পারে। আমাদের লাখ লাখ তরুণের দক্ষতা কাজে লাগাতে প্রচুর কর্মসংস্থানের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ একটি রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে আমাদের সরকার প্রথমেই সংস্কার কাজ শুরু করেছে। আমাদের নীতিগত সংস্কার বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করার জন্য সাজানো হয়েছে।’
চীনা বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ আমরা একসঙ্গে এই যাত্রা শুরু করছি, আমি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি বাংলাদেশে বিদ্যমান বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে। টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, পাট, মৎস্য ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিটি খাতেই বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্বের উপযোগী সুযোগ রয়েছে। এখানে বিনিয়োগ করে ম্যানুফেকচারিং হাব তৈরি করুন।’
চীনা বিনিয়োগকারীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের অর্থনীতি পাল্টে দিয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সম্মেলনে আপনাদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনার প্রতীক। চীনা বিনিয়োগকারীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের অর্থনীতি পাল্টে দিয়েছে। আমরা আশা করি, এই সফর বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একটি অনুরূপ রূপান্তরের সূচনা করবে।’
বাংলাদেশ এক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে, নীতিমালা সহজ করতে এবং ব্যবসার জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই উদ্যোগগুলোর লক্ষ্য বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত এবং আমাদের তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।’
বিনিয়োগ সম্মেলনে চীনা ব্যবসায়ীরা অংশগ্রহণ করায় তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনাদের সবাইকে ঢাকা শহরে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে পেরে আমি গভীর আনন্দ ও সম্মান অনুভব করছি। এটি আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এ বছর বাংলাদেশ ও চীনের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এই সম্মেলন আমাদের সম্পর্ক ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আপনাদের উপস্থিতি আমাদের দুই দেশের মধ্যকার সুগভীর সম্পর্ক এবং পারস্পরিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে।
সরকারপ্রধান বলেন, পাট নিয়ে আলাপ বাংলাদেশের জন্য অনেক আবেগী বিষয়। এই দেশ প্রাকৃতিক এই আঁশ বিপুল আকারে উৎপাদন করে। যখন আপনারা পাট এবং পাটজাত পণ্য নিয়ে কথা বলেন তখন এটি এই দেশের জন্য অনেক বড় বিষয়। আমরা পাটের মধ্যে একটা ভবিষ্যৎ দেখতে পারি। কারণ পাট দিয়ে এতদিন শুধু বস্তা তৈরি করা হতো। বিশ্বের একটি প্রাকৃতিক আঁশকে আমরা সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা একসঙ্গে পাট নিয়ে একটি নতুন সূচনা করতে পারি এটিকে অর্থনীতিতে তার সঠিক জায়গায় স্থাপন করে। পাটের মতো আরও অনেক পণ্য আছে যেগুলো বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়। জামদানির মতো আরও অনেক পণ্য আছে যেগুলো থেকে আরও অনেক ভিন্ন পণ্য তৈরি করা যায়। কিন্তু এটি শুধু শাড়ি বানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য মসলিনকেও এভাবে ফিরিয়ে আনা যায়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের আকাশ ছুঁতে পারার মতো একটি ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হবে। এই সক্ষমতা আমাদের আছে। এপ্রিলে আমরা একটি সফল বিজনেস সামিত আয়োজন করেছি। পাঁচ দিনের এই মিলনমেলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন কোম্পানি এখানে এসেছিল। এখন আবার পুনরায় চীন থেকে একটি বড় ব্যবসায়ী দল এসেছে। বিনিয়োগ সম্মেলনে একটি চীনা টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান একাই ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুথানের পরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পুনর্গঠন করেছে। এখানে আমরা প্রাইভেট সেক্টর থেকে মেধাবীদের নিয়ে এসেছি। নতুন এই সংস্থা আপনাদের বিনিয়োগের যাত্রায় সহযোগিতা করবে। আমি চীনা বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানাই বাংলাদেশকে নিজেদের ঘর হিসেবে তৈরি করুন।’
প্যানেল