ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সুস্থ ও কৃত্রিমভাবে মোটাতাজাকৃত কোরবানির গরু চেনার উপায়

আ. ন. ম. রিসালাত আলিফ,  কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ১৩:৫৪, ৩১ মে ২০২৫

সুস্থ ও কৃত্রিমভাবে মোটাতাজাকৃত কোরবানির গরু চেনার উপায়

ছবি: সংগৃহীত

আর কিছুদিন পরেই উদযাপিত হবে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা, যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা গবাদিপশু কোরবানি করে থাকেন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাজারে পশু কেনাবেচা বেশ জমজমাট হয়। তবে দুঃখজনকভাবে, কিছু লোভী ব্যবসায়ী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ ও ক্ষতিকর পন্থায় পশুকে অস্বাভাবিকভাবে মোটা করে তোলার চেষ্টা করেন। অধিক লাভের আশায় তারা পশুর শরীরে স্টেরয়েড ও অন্যান্য ক্ষতিকর ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার করেন, যা প্রাণীর স্বাভাবিক স্বাস্থ্যহানির পাশাপাশি মানুষের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে। বাহ্যিকভাবে এসব পশু দেখতে সুস্থ ও সবল মনে হলেও, বাস্তবে সেগুলো নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত থাকে। এর মাংস খাওয়ার ফলে মানুষের শরীরে পানি জমা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আর তাই এমন সব সমস্যা হতে পরিত্রাণ পেতে কোরবানির গরু কেনার সময় সুস্থ গরু এবং কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজাকরণ করা গরু চেনার উপায় নিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন এবং প্রাণীবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. বাহানুর রহমান। একইসঙ্গে, খামারিদের উদ্দেশে গরুকে কৃত্রিম মোটাতাজাকরণ থেকে বিরত রাখার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

সুস্থ গরু চেনার উপায় সম্পর্কে অধ্যাপক বলেন, সুস্থ গরুর নাকের ওপরের অংশ ভেজা বা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা থাকবে। সুস্থ গরুর চামড়ায় কোনো দাগ থাকবে না এবং গরুর গায়ে স্পর্শ করা হলে সে স্থানে সেনসেশন দেখা যাবে। সুস্থ গরু সর্বদা চঞ্চল থাকবে। সুস্থ গরুর ক্ষেত্রেও যখন তাকে অনেক দূর থেকে হাঁটিয়ে হাটে নিয়ে আসা হয় তখন শরীরের তাপমাত্রা বেশি হতে পারে, কিন্তু তা এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। সুস্থ গরুগুলো কোনো খাবার দেখলেই খাওয়ার আগ্রহ দেখাবে, খেতে চাইবে। যেসব গরুর মুখে কম লালা বা ফেনা থাকে, সেই গরু কেনার চেষ্টা করুন। সুস্থ গরু নিয়মিত জাবর কাটে। সুস্থ প্রাণীর রং চকচকে থাকবে, তবে এর কুঁজ মোটা থাকবে এবং চামড়া টানটান থাকবে। প্রাকৃতিকভাবে মোটাতাজা করা পশুর গায়ে চাপ দিলে মাংস খুব বেশি দেবে যাবে না এবং যতটুকু দেবে যাবে, তা সঙ্গে সঙ্গে আগের অবস্থায় চলে আসবে।

কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরু চেনার উপায় সম্পর্কে অধ্যাপক বলেন, কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর নাক থাকবে শুকনা। কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর দেহ থলথলে থাকবে এবং দেহে পানির পরিমাণ বেশি বোঝা যাবে। কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরু ঘন ঘন শ্বাস নেবে। একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে যাবে, সর্বদা ক্লান্ত দেখাবে। কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরু সাধারণত অসুস্থ থাকে এবং দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। এসব গরুতে ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, ফলে তারা সহজে খাবার খেতে চায় না। এদের মুখ দিয়ে অতিরিক্ত লালা ঝরতে পারে, যা কখনো ফেনাযুক্ত আবার কখনো ফেনাবিহীনও হতে পারে। কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরু স্বাভাবিক গরুর মতো নিয়মিত জাবর কাটে না। এ ধরনের গরুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে অস্বাভাবিকভাবে মাংস বেড়ে যায়, যা অসমভাবে বণ্টিত থাকে। গরুর শরীরে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে সেই অংশ দেবে যায় এবং আগের অবস্থায় ফিরতে বেশ সময় লাগে। ইনজেকশন দিয়ে মোটাতাজা করা গরুর রানের মাংস সাধারণ গরুর তুলনায় অনেক বেশি নরম হয়। এ ধরনের গরুর হাড় বেশ নরম ও নমনীয় থাকে, ফলে কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে গেলে হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। শরীরে অতিরিক্ত পানি জমার কারণে এসব গরু ভারী হয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে চায় না, একজায়গায় বেশি সময় বসে থাকে। তাই গরুটি বসে থাকলে উঠিয়ে হাঁটিয়ে দেখা উত্তম, এতে তার শারীরিক অবস্থা বোঝা যায়।

হাটে অনেক সময় পশুটি অসুস্থ নাকি সুস্থ এটি নির্ণয় নিয়ে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে কনফিউশন হতে পারে। সেক্ষেত্রে সহজে কিছু চেনার উপায় জানিয়েছেন অধ্যাপক বাহানুর। তিনি বলেন, যদি তাপমাত্রার কথাই ধরি তাহলে পশুর তাপমাত্রা মানুষের মতো মাপা যায় না, পশুর ক্ষেত্রে রেকটাল টেম্পারেচার (মলাশয়ের তাপমাত্রা) নিতে হয়। কিন্তু কেনার সময় তা করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে পশুর কানের গোড়ায় হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায় সহজেই। এছাড়া আরেকটি সহজ উপায় হলো গরুর নাকের উপরের অংশে (মাজল) হাত দিলে স্থানটি যদি শুকনা মনে হয় তাহলে ধরে নিতে হবে গরুটি অসুস্থ।

খামারিদের উদ্দেশ্যে অধ্যাপক বাহানুর বলেন, বেশিরভাগ খামারিরা কোয়াকদের (হাতুড়ে ডাক্তার) প্ররোচনায় পড়ে কৃত্রিম উপায়ে পশু মোটাতাজা করেন। তারা পশুকে ডেক্সামিথাসন, প্রেডনিসোলন জাতীয় ওষুধ সেবন করিয়ে অথবা ইনজেকশন প্রয়োগ করে কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করে। এতে পশুর যকৃত, কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পশুকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। খামারিদের উচিত প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করা। খামারিরা এক্ষেত্রে উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি সার্জনদের শরণাপন্ন হলে ভালো সুপরামর্শ পাবে বলে আমি মনে করি।

মুমু

×