
ছবি: প্রতীকী
বর্তমান পৃথিবী প্রযুক্তিনির্ভর এক নবযুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence) কেবল একটি প্রযুক্তিগত উপাদান নয়, বরং মানব সভ্যতার কাঠামো পরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশও এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধারায় যুক্ত হচ্ছে, আর এই যাত্রার একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপনের প্রয়াস হচ্ছে “জাতীয় এআই নীতিমালা ২০২৪”।
সাম্প্রতিক সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ জাতীয় এআই নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করেছে, যা বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সম্ভাব্যত জুলাই মাসে এটি সরকারিভাবে জারি হবে। এটি নিঃসন্দেহে দেশের প্রযুক্তি খাতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। এর আগে ইউনেসকো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপির সহায়তায় প্রস্তুতকৃত “বাংলাদেশ এআই রেডিনেস অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট” ছিল একটি যুগোপযোগী নির্দেশনা।
খসড়া নীতিমালায় একটি বিস্তৃত কাঠামো চিত্রিত হয়েছে, যেখানে প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার, মানবিক অধিকার, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার বিষয়গুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ৩.৬ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার হবে মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে। ৫.২.২ ধারায় নীতিশাস্ত্র ও নীতিমালার সংযোজন এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে ৩.২ ধারায় ডেটা ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ একটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল দেশ। তাই ইউনেসকোর নৈতিক সুপারিশগুলো ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। বিশেষত, এআই সঙ্গী, ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের মতো প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে দেশের নিজস্ব মূল্যবোধ ও ভাষাভিত্তিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখা আবশ্যক।
বিশ্বব্যাপী এআই অপব্যবহারের ঝুঁকি যেমন হ্যাকিং, ডিপফেক, চাঁদাবাজি, তথ্য বিকৃতি ইত্যাদি বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, ভারতসহ অনেক দেশ ইতোমধ্যে এআই আইন ও নীতিমালা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এখন পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রায় ১০ লাখ ব্যক্তি এআই ও মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করছেন। এই বিশাল কর্মবলয়ের নিরাপদ ও সুশাসিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে শক্তিশালী নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি।
নীতিমালায় আইনি ও বাস্তবায়ন কাঠামো থাকলেও বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে এখনও নির্দিষ্টতা নেই। তবে একটি সুসংগঠিত বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা ভবিষ্যতে বাজেট সংযোজন ও রূপায়ণের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।
নীতিমালার ৭ নম্বর অধ্যায়ে বলা হয়েছে, প্রতি তিন বছর অন্তর এটি পর্যালোচনা করা হবে এবং অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এটি নিশ্চিত করে যে এই নীতিমালা শুধুমাত্র এককালীন নয়, বরং গতিশীল ও প্রসারিত হতে সক্ষম।
জাতীয় এআই নীতিমালা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠবে। তবে এই যাত্রায় সফলতা নির্ভর করবে এর বাস্তবায়ন, নজরদারি এবং মানবকেন্দ্রিক মূল্যবোধ রক্ষার উপর। আমাদের উচিত হবে কেবলমাত্র প্রযুক্তির দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া নয়, বরং সেই প্রযুক্তিকে নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত করা—যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিরাপদ, উন্নত এবং সুশাসিত ডিজিটাল রাষ্ট্র পায়।
লেখক: সিনিয়র মার্কেটিং এক্সপার্ট, বালিপ টেক, ঢাকা। ইমেইল: [email protected]
এম.কে.