
সিরিজ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: মানবজাতির ভবিষ্যৎ - আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নিয়ে আমাদের আগ্রহ যত বাড়ছে, ততই একটা প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। “আমার চাকরিটা কি থাকবে?” আধুনিক প্রযুক্তির এই অগ্রগতি যেমন কাজের গতি ও দক্ষতা বাড়াচ্ছে, তেমনই বহু প্রচলিত পেশা হারানোর আশঙ্কাও তৈরি করছে। এই পর্বে আমরা বিশ্লেষণ করব, কিভাবে AI চাকরির বাজারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক-দুই ধরনের প্রভাব ফেলছে।
১. রুটিনভিত্তিক কাজের অটোমেশন
AI প্রথমে দখল করছে সেইসব কাজ, যেগুলো একঘেয়ে, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং নির্দিষ্ট নিয়মে চলে। যেমন:
• ব্যাংকে চেক প্রসেসিং
• কল সেন্টারে স্বয়ংক্রিয় গ্রাহকসেবা
• গুদামে পণ্য সাজানো
• হিসাবরক্ষণ ও ডেটা এন্ট্রি
এই কাজগুলোতে মানবিক বিশ্লেষণ বা আবেগ-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয় না। ফলে এগুলোতে রোবট ও সফটওয়্যার সহজেই মানুষকে প্রতিস্থাপন করছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটা চিন্তার বিষয়, কারণ সস্তা শ্রমনির্ভর অনেক কাজ এখানে প্রচলিত, যেগুলো দ্রুতই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যেতে পারে।
২. নতুন পেশার জন্ম
তবে AI কেবল কাজ কেড়ে নিচ্ছে না, বরং একদম নতুন ধরনের পেশাও তৈরি করছে। যেমন:
• ডেটা সায়েন্টিস্ট
• মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার
• AI মডেল ট্রেইনার
• অ্যালগরিদম ডিজাইনার
• কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নৈতিকতা বিশেষজ্ঞ
এই পেশাগুলো দশ বছর আগেও অনেকের কল্পনাতেও ছিল না। এখন এসব ক্ষেত্রেই বাড়ছে চাহিদা। এখানে মানুষের বিশ্লেষণী ক্ষমতা, নৈতিক মূল্যবোধ এবং সৃজনশীলতা AI-কে সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করছে।
৩. হাইব্রিড কাজের বাস্তবতা
সব পেশায় AI এসে মানুষকে পুরোপুরি সরিয়ে দিচ্ছে না। বরং অনেক জায়গায় AI এখন একজন দক্ষ সহকারী।
• চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয়ে AI-এর সহায়তা নিচ্ছেন, তবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন নিজেরাই।
• শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর দুর্বলতা চিহ্নিত করতে AI ব্যবহার করছেন, কিন্তু শেখানোটা করছেন স্বশরীরে।
এই সহমিলন নতুন ধরনের কর্মসংস্থানের দ্বার খুলে দিচ্ছে, যার নাম হতে পারে—“Human-AI Collaboration”-নির্ভর পেশা।
৪. দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজন
AI-এর যুগে টিকে থাকতে হলে শুধু প্রথাগত ডিগ্রি নয়, চাই নতুন দক্ষতা। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো:
• কোডিং ও প্রোগ্রামিং
• ডেটা বিশ্লেষণ
• ডিজিটাল মার্কেটিং
• AI সম্পর্কে মৌলিক ধারণা
• সমস্যা সমাধানের কৌশল ও সৃজনশীলতা
এ কারণে “Reskilling” ও “Upskilling” এখন একটি বৈশ্বিক ট্রেন্ড। কর্মজীবীদের নতুন প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ।
৫. উন্নয়নশীল দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের মতো দেশে AI-এর আগমন একটি জটিল বাস্তবতা তৈরি করছে। আমাদের অনেকেই কাজ করেন গার্মেন্টস, কৃষি, পরিবহন বা সাধারণ সেবা খাতে-যেখানে প্রযুক্তিগত দক্ষতা খুবই সীমিত। এই পেশাগুলোতে অটোমেশন এলে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি হলো-
• প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ চালু করা
• শিক্ষাব্যবস্থায় AI-সংশ্লিষ্ট বিষয় যুক্ত করা
• সরকারি, বেসরকারি খাত ও এনজিওদের যৌথ উদ্যোগে প্রস্তুতি নেওয়া
শেষ কথা
AI কি চাকরি কেড়ে নিচ্ছে? আংশিকভাবে হ্যাঁ। কিন্তু একইসঙ্গে এটি নতুন কাজের সুযোগও তৈরি করছে, কিছু কাজকে সহজ করছে, এবং কর্মপদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন আনছে। বাস্তবতা হলো, আমরা এক পরিবর্তনশীল জগতে বাস করছি, যেখানে স্থায়ী চাকরি নয়, বরং অভিযোজনযোগ্য দক্ষতা টিকে থাকার চাবিকাঠি।
তাই ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানে টিকে থাকতে হলে আমাদের শিখতে হবে, রপ্ত করতে হবে, এবং প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
পরবর্তী পর্বে থাকবে
পর্ব ৪: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মানবীয় মূল্যবোধ: নৈতিকতা ও দ্বন্দ্ব
লেখক: সোহাইল আহমেদ
কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক
রাজু