
অতি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক বিশ্বের এই সভ্য সময়েও দর্শন মানুষের ভাবনার জগতকে প্রকৃষ্টরুপে ভাবতে শিখিয়েছে। যদিও চিন্তার জগতে অসত্য বলে কিছু নেই। তবু প্রকুতপক্ষে দর্শনের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করা হয়। সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকেই মানুষ আশেপাশের বস্তু-জগৎ-জীবন-সংসারের ন্নাাবিধ টানাপোড়েন সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করে। আর তাই দর্শন কেবল জীবনের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করারর জন্যই নয় বরং জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনেই নানাবিধ দার্শনিক আলোচনার গুরুত্ব বেড়েছে। সময়ের প্রয়োজনে ভাববাদী দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ মতবাদসমূহের সঠিক প্রয়োগ ঘটানোর জন্যই প্রয়োগবাদী দর্শনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আধুনিক বিশ্বের এই সভ্য সমাজে জনসংখ্যার সাথে সাথে বিভিন্ন বিষয়ে অধিক মেধা সম্পন্ন উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও আনুপাতিক হারে প্রকৃত মানুষের সংখ্যা মোটেই বাড়ছে না। লোভ-সংঘাত-ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্বে আজ বেজায় ব্যস্ত প্রতিটি পরিবার-জাতি-গোষ্ঠী-রাস্ট্র! উচ্চ শিক্ষায় সনদ প্রাপ্ত সত্ত্বেও কেবল মাত্র সঠিক প্রয়োগ আর আত্ন-শুদ্ধির অভাবে প্রকৃতপক্ষে জাতির কল্যাণে সেই সনদসমূহ অর্থহীন হয়ে পড়ে। আধুনিকতার নামে রঙ্গিন আলোকছটায় শিক্ষিত জাতি অকালে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। প্রজন্মান্তরে বিবেক প্রতিবন্ধীর কালগ্রাসে জাতি যেন বাধ্য হয়েই মাথা নত করছে। এমন অশনি সময়েই তো দর্শন শাস্ত্রের মাধ্যমেই প্রকৃত সমাধান মিলবে নিশ্চয়ই। অর্থাৎ দর্শন শাস্ত্রের মাধ্যমেই এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে মানুষের অন্তরালে লুক্কায়িত জ্ঞানসমূহ বিকশিত করতে হবে ঠিক এক্ষুণি।
এটি সত্য যে, প্রায় প্রতিটি যুগেই তরুণ প্রজন্ম যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র। নি:সন্দেহে বলা যায়. তারুণ্যের অদম্য স্পৃহায় অনেক দূর্গম পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সঠিক দিক-নির্দেশনা, সুস্থ চেতনা আর দৃঢ় প্রত্যয়। তরুন প্রজন্মের দীপ্যমান প্রদীপের শিখায় আলোকিত হোক আমাদের সমাজ- এ যেন আমাদের সকলের কাঙ্খিত চাওয়া। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের ইতিহাসে তরুণদের নাম সোনার হরফে লেখা থাকবে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তরুণ সমাজের অগ্রণী ভূমিকা অনেক প্রশংসনীয়। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ বিভিন্ন সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে প্রানপণে লড়ছে। এতদসত্ত্বেও আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেই চলেছে। প্রতিনিয়ত যুব সমাজকে কলুষিত করছে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল। বড্ড অসময়ে অদৃশ্য অপশক্তি অপরাধের মহাসমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ক্রমাগতভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের বিস্তার হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। আদর্শ বিবর্জিত আধুনিক প্রজন্ম অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রতিটি পরতে পরতে অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা, অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা এ জাতীয় নেতিবাচক দিকগুলো অনুশীলন করছে। এছাড়া মানসিক হতাশাগ্রস্ত লাখো যুবক মাদকাসক্তিতে ঝুঁকছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে ৩৬ লাখের মতো মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ রয়েছে। যেখানে যুবকেরা একটি দেশের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করার কথা, সেই যুব সমাজই যদি নেশায় আসক্ত হয়ে বুঁদ হয়ে থাকে ঘরের কোণে তাহলে পরিণাম কী হতে পারে?
সঙ্গত কারণেই আজকের এই ঘুঁনেধরা সমাজটাকে পরিবর্তন করে মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন আলোকিত মানুষ। সত্যিকার অর্থে আলোকিত মানুষ তারাই যারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে শক্তিমান নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যাদের নিরঅহংকার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সততা এবং কর্ম মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করে তারাই আলোকিত মানুষ। আলোকিত মানুষ হতে হলে অবশ্যই আদর্শ মানুষ হতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক দর্শনের আলোয় উদ্ভাসিত হতে হবে। এটি সত্যি যে, ভালো মানুষ অন্তর থেকেই ভালো, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁদের ইতিবাচক দর্শন অন্যকে অনুপ্রাণিত করে তোলে। নি:সন্দেহে এটি বলাই যায়, অন্তর থেকে কেউ ভালো মানুষ না হলে তার পক্ষে আলোকিত মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে দার্শনিক গুরু সক্রেটিস যেমন বলেছেন, ‘সদ্ব গুণই জ্ঞান’। অর্থাৎ অসৎ ব্যক্তি জ্ঞানী হতে পারে না। তাই খুব সহজেই বলা যায় বলা যায়, আলোকিত মানুষের দর্শন এমন হওয়া উচিৎ যার মধ্যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সততা, পরোপকারীতা, বিনয়ী এবং সত্য সন্ধানের ইচ্ছাশক্তি সরবদাই বিদ্যমান।
দর্শনের আলোয় আলোকিত হতে হলে প্রতিটি মানুষের জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। কাঙ্খিত আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য এবং সামাজিক কুসংস্করতা ও অজ্ঞতা দূর করার পূর্ব শর্তই হলো বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সখ্যতা গড়ে তোলা। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআন- এর যে বাণী শুনতে পেয়েছিলেন তা হলো, ‘আল্লামা বিল কলাম’। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন, কলমের মাধ্যমে। আর কলমের আশ্রয়তো পুস্তকে। পবিত্র কোরআন মজিদে আরও বলা হয়েছে, ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। পড়, আর তোমার রব মহামহিম।’ (সূরা আলাক :১-৩)। নবী করিম (সা.) হাদিসে উল্লেখ করেছেন, ‘ঘন্টা খানেকের জ্ঞান সাধনা সমগ্র রজনীর ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’। অর্থাৎ নবী করিম (সা.) এর দর্শন অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকের বিদ্যা শিক্ষা বা বইয়ের বিকল্প নেই।
আমাদের বর্তমান সমাজ যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তার থেকে পরিত্রান পেতে হলে সমাজের স্বশিক্ষিত মানুষগুলোর আদর্শিক আলোয় উদ্ভাসিত হতে হবে। আমাদের যুব সমাজ আজ অস্থির সময় পার করছে। সঠিক পথ বেছে নিতে গিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের দিক নির্দেশক হতে পারেন দর্শনের জ্ঞান সমৃদ্ধ আলোকিত মতবাদসমূহ ও অনুকরণীয় মানুষগণ। আর তবেই তো যোগ্য প্রজন্মের মাথায় শোভা পাবে দর্শনের আলোকে আদর্শ সমৃদ্ধ জ্ঞানের মুকুট। সার্বিক বিবেচনায় দর্শনের আলোয় উদ্ভাসিত হোক বর্তমান প্রজন্ম। এক্ষেত্রে আশু প্রয়োজন আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা!নিয়মিত চর্চা করতে হবে আমাদের সঠিক পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের।
লেখক : শিক্ষক
প্যানেল