
সম্পাদকীয়
গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় ১০ মাস পর এই প্রথম কোনো মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। রবিবার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করার সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট বিবরণ তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি ট্রাইব্যুনালকে বলেন, শেখ হাসিনার অধীন অন্য অপরাধীরা বিশ্বাস করতেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকলে তারাও টিকে থাকবেন এবং শত অপরাধ করা সত্ত্বেও তারা নিরাপদে থাকবেন। আনুগত্যের জন্য পুরস্কৃতও হবেন। এই অপরাধীদের প্রাণভোমরা তিনি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত তিনটি মিস কেস বা বিবিধ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত বিবিধ মামলায় গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেই তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনার পর গত রবিবার তা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে দাখিল করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
উল্লেখ্য, ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে দাখিল করা হয়। বিচার কার্যক্রম জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হয়, যা ছিল নজিরবিহীন। সংক্ষেপে হাসিনার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৫ অভিযোগ হলোÑ গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে উস্কানিমূলক বক্তব্য, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ, রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ হত্যার প্ররোচনা ও নির্দেশ, ঢাকার চাঁনখারপুলে ছাত্র হত্যা এবং ঢাকার আশুলিয়ায় হত্যা, লাশ পোড়ানো।
বক্তব্যের শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বিশ্ববিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার উস্কানি ও সরাসরি নির্দেশ রয়েছে। এ বিষয়ে তার বহু কল রেকর্ড, অডিও-ভিডিও পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে এসেছে, প্রায় দেড় হাজার লোককে হত্যা, ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত, নারীদের ওপর বিশেষভাবে সহিংসতা চালানো, লাশ একত্রিত করে পুড়িয়ে দেওয়া, আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিতে ও চিকিৎসকদের চিকিৎসা দিতে এবং পোস্টমর্টেম করতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
বলাবাহুল্য, শেখ হাসিনার বিচারিক কার্যক্রমের দিকে কেবল দেশের মানুষই নয়, বিশ্বের বহু গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষক সংস্থা ও মানবতাবাদী সংগঠনেরও নজর থাকবে। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গণহত্যার বিবরণ চলতি বছর জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। পেশাগত দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও দায়িত্বশীলতা এবং প্রত্যাশিত সততা, আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতার ভেতর দিয়ে বিচারিক কার্যক্রম কোনোরূপ অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজস্ব গতিতে এগোবে, এমনটাই প্রত্যাশা। আমরা জানি, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ ন্যায় বিচারের প্রথম শর্ত। আর সামাজিক সুস্থতার জন্যই ন্যায়বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসী আশা করে এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে দেশের আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। কেননা আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন।