ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হজ বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন

খালিদ ইবনে আমিন

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ৩ জুন ২০২৫

হজ বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন

হজের ইতিহাস প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরানো। হজ ইসলামের (কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত) পঞ্চস্তম্ভের একটি। কেবলমাত্র শারীরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সামর্থ্যবান মুসলিম বালেগ নারী-পুরুষের ওপর হজ ফরজ। সামর্থ্য থাকার পরও যদি কেউ হজ সম্পন্ন না করেন তবে সে অবশ্যই গুনাহগার হবেন। আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতি বছর ৭০-৮০ লাখ মুসলিম পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মক্কায় সমবেত হন। সবার মুখে একই আওয়াজ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। হে আল্লাহ তোমার ডাকে আমি উপস্থিত। তোমার কোনো শরিক নেই। তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। সর্বপ্রকার প্রশংসা ও নিয়ামত সামগ্রী সব কিছুই তোমার। সর্বযুগে ও সর্বত্র তোমারই রাজত্ব চলমান। তোমার কোনো অংশীদার নেই, তুমি কারো মুখাপেক্ষি নও। 
একমাত্র তুমিই যাবতীয় ভুলভ্রান্তি মাফ করার ক্ষমতা রাখো। তোমার হুকুম অনুসারেই আমাদের চলতে হবে। তোমার অনুগ্রহেই আমাদের পাপ মুক্তি হবে, তুমিই মোদের পথ চলার সারথি। হজ নামক বিশ্ব মানবতার এই মহাসম্মেলনে পার্থিব কোন স্বার্থ নেই কারও। শুধু আল্লাহর ডাকে একাগ্রচিত্তে সাড়া দিয়ে সমবেত হওয়া এবং প্রভুর একত্ব ঘোষণা করা। প্রভুর মাহাত্ম্য, বিশালত্ব ও প্রাধান্যকে স্বীকার করা। এক বাক্যে শিরক পরিহার করে আল্লাহকে একমাত্র প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নেয়া। প্রতিটি মানুষের একই ঘোষণা, মক্কা-মদিনার আকাশে, বাতাসে, ইথারে ধ্বনিত হতে থাকে, “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বইক, লা শারিকালাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা অন্নিয়’মাতা, লাকাঅল মুলক”। শ্বেতশুভ্র শিলাইবিহীন বস্ত্র পরিধান করে তালবিয়া পাঠ, সে এক অভাবিত পুণ্যাত্মিক দৃশ্য, অকল্পনীয় অনুভূতি। সব মানুষ তার প্রভুর কাছে হাজিরা দিতে পাগল পারা। প্রভুর ইচ্ছামতো শিরক থেকে বিরত থাকার জন্য বারংবার ঘোষণা দেয়া।
সারা বিশ্বের বিশ্বাসী মানুষদের হজ করার জন্য আল্লাহ প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন। এটা আল্লাহর অকাট্য হুকুম। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের অবশ্যই হজ পালন করার জন্য খানায়ে কা’বা জিয়ারত করতে হবে। আর এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দুনিয়ার মুসলিমরা যাদের মক্কা-মদিনা যাতায়াতের সামর্থ্য আছে তাঁরা হজের জন্য সমবেত হন প্রতি বছর। সে বিবেচনায় বলা যায় হজের দুটি লক্ষ্য- প্রথমত, আল্লাহর হুকুম পালন করা। শিরক পরিহার করে এক আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা করা। দ্বিতীয়ত, মহাসম্মেলনে যোগদান করে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করা, আল্লাহর নিয়ামত ও কল্যাণ লাভ করা। একজন মুমিনের অমূল্য সম্পদ হলো, আল্লাহর নৈকট্য লাভ, তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা স্থাপন তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে এবং ইবাদতের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। 
হজ হলো, তাকওয়াপূর্ণ ইবাদতের অনন্য কর্মশালা। শিরক, কুফর ও বিদআ’ত মুক্ত ইমানের অনুপম পাঠশালা। হজ নামক পাঠশালাতেই আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর থেকে গভীরতম আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন হতে পারে। আল্লাহর সামনে দীনতা হীনতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔজ্জ্বল্য পায় একজন হাজি সাহেবের আত্মা। আনুগত্যের অনন্য পরাকাষ্ঠায় নানামুখী সুষমায় সিক্ত হয় গোলামের মন ও মনন। হজ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ সাক্ষাতের সংকল্প করা। এ সাক্ষাৎ দুনিয়ার কোনো মানুষের সঙ্গে দৈহিক সাক্ষাৎ নয়। এ সাক্ষাৎ হলো, মহান স্রষ্ট্রার সঙ্গে সৃষ্টির আধ্যাত্মিক মেলবন্ধন, যা কেবল ঐশ্বরিক চেতনার মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়।
হজরত আদম আঃ থেকে অদ্যাবধি এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নিবে, আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে এবং সামর্থ্যবান হবে, তাদের প্রত্যেকর ওপর হজের বিধান পালন করা ফরজ থাকবে। পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সামর্থ্যবান মুসলিমগণ পবিত্র কা’বা ঘরে ছুটে আসেন যিয়ারতের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসে। হাজিগণ মাসাধিক কালব্যাপী মক্কায় সমবেত হতে থাকলেও হজের আনুষ্ঠানিকতা হয় মূলত ৩ দিন। যে যখনই মক্কা বা মদিনায় পৌঁছে থাকুক না কেন হজের ৩ দিন সবাই একত্রিত হয় মক্কায়। পবিত্র কা’বাগৃহের তওয়াফ শেষ করার পর হাজিরা সবাই রওনা হয়ে যায় মিনায়, যে যার কাফেলা নিয়ে। 
সেখানে এক রাত কাটানোর পর সবাই রওনা হয় আরাফার ময়দানে। এখানে এক রাত কাটিয়ে পরদিন সবাই আরাফার জামায়াতে শরিক হয়। আসরের নামাজের পর সবাই রওনা হয় মুজদালিফা। সেখানে মাগরিব ও ইশার নামাজ এক সঙ্গে আদায় করে। সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করা হয় ইবাদতের মাধ্যমে। ভোর বেলায় আবার মিনায় গিয়ে সবাই হাজির হয়। দুপুরের আগেই সবাই ছুটে যায় জামরাতে শয়তানকে ঢিল ছুড়তে। পরদিন একইভাবে ঢিল ছুড়ে সবাই রওনা হয় কা’বাগৃহ তাওয়াফ করতে। এভাবে হজের মূল কর্মসূচি সমাপ্ত হয় তিন দিনের মধ্যে। আর এ কাজগুলো সব হজযাত্রী তিন দিনের মধ্যে আগ-পাছ করে সম্পন্ন করলেও আরাফার ময়দানের জামায়াত হয় এক সঙ্গে। এ সময় ৮০ লাখ বহিরাগত হাজি ও স্থানীয় লোক মিলে প্রায় কোটি কণ্ঠে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা হয়। নিজ নিজ গোনাহ মাপের জন্য দোয়া করা হয়। মুসলিম উম্মার উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। আরাফাত, মুজদালিফা ও মিনার ময়দানে অবস্থান করা এবং শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা, পশু কোরবানি দেওয়া অবশেষে পুরুষদের চুল কামিয়ে ফেলা। পবিত্র স্থানসমূহের মধ্যে হাজিদের বিচরণ, বাইতুল্লাহ তাওয়াফ, হাজরে আসওয়াদে চুম্বন। হজের সকল কর্মকাণ্ডেই সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে শরিয়তের প্রতি প্রবল আনুগত্য, আত্মসমর্পণ ও সর্বান্তকরণে শরিয়তের সকল বিধি-বিধান মেনে নেয়ার জীবন্ত কোশেশ। এই আনুষ্ঠানিকতাগুলোর সমন্বিত নামই হলো হজ, যা মুসলিম বিশ্বের মহাসম্মেলন হিসেবে পরিচিত।
হজের আনুষ্ঠানিকতা ৩ দিনের হলেও হাজিরা মক্কা ও মদিনায় অবস্থান করেন প্রায় মাসাধিক কাল। এতে যোগাযোগ হয় দেশ-বিদেশের হাজারো মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে। ভাব বিনিময় হয় সাদা কালো উঁচু-নিচু শাসক ও শাসিত সর্ব শ্রেণির মুসলিম মিল্লাতের সঙ্গে। এতে জানতে পারা যায় বিভিন্ন দেশের কৃষ্টি, কালচার, পরিবেশ, পরিস্থিতি। অনুমান করা যায় সে দেশের মুসলিম উম্মার অবস্থান। লক্ষ্য করা যায় বিচিত্র আচার আচরণ। আরও পরিচিত হওয়া যায় ভিন্ন ধরনের পোষাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাভাস ও চাল চলন সম্পর্কে। দীর্ঘ এক মাসকাল মক্কা বা মদিনায় অবস্থানের কারণে আলাপ পরিচয়ও হয়ে উঠে পরস্পর ভিনদেশীয় মুসলিম ভাইদের সঙ্গে। জানতে পারা যায় তাদের ব্যবহারিক রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই গড়ে উঠে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব। এভাবেই হজ ব্রত পালন করতে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠে। সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে। 
একজন আরেকজনকে স্মরণ রাখার জন্য যোগাযোগের ঠিকানার আদান প্রদান হয়। পরবর্তীতে চিঠি, ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগের সেতু বন্ধন রচিত হয়। পরস্পরকে আমন্ত্রণ জানানো হয় তাদের নিজ নিজ দেশে ভ্রমণ করার জন্য। হজ অনুষ্ঠান শেষ হলেও যোগাযোগ চলতে থাকে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে। এভাবেই হজকে কেন্দ্র করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব দীর্ঘায়িত হতে থাকে। সবাই সবাইকে আরাফার ভাই হিসেবে সম্বোধন করতে থাকে। সময় সুযোগে অনেকেই এ সূত্র ধরে বিদেশ সফরের প্রোগ্রাম রচনা করে। সহযোগিতা পেয়ে থাকে আরাফার ভাই হিসেবে। প্রযুক্তির দুনিয়া যোগাযোগকে আরও সহজ করে দিয়েছে। 
আরাফার এ সূত্র ধরে ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্যোগও নিয়ে থাকে অনেক ভাই। আবার দীনি চেতনার অভিজ্ঞতাও অর্জন করা যায় এসব সূত্র ধরে। আরাফার এ মহামিলনের মূল লক্ষ্যই হলো দীনের দাওয়াত সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া। সে কাজটিও সহজ হয় এই হজের বদৌলতে। হজের এ মহামিলন চলতে থাকবে চিরকাল ধরে। আর বিশ্বভ্রাতৃত্বের পরিসরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে দিনের পর দিন এ প্রত্যাশা মুসলিম মিল্লাতের। হজ, গোটা জীবনে একজন সামর্থবান মুসলিমের জন্য একবারই ফরজ ইবাদত। সারা বছর অন্য সময় মুসলিমরা কা’বা কেন্দ্রিক যে ইবাদত করে থাকে তা হলো, উমরাহ ও বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা।
এই কাবাঘর আর দশটা সাধারণ মসজিদের মতো কোনো ইমারত নয়। এটি বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচারের মূল কেন্দ্রভূমি। কা’বা ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল, গোটা দুনিয়ার ইমানদার লোকেরা এখানে মিলিত হবে এবং সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে। আবার এখান থেকে ইসলামের বিপ্লবী দাওয়াত নিয়ে নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে যাবে ইসলামের সুমহান বাণী নিয়ে এবং তা প্রচার করবে। আর এখানেই হজের দীপ্তময় সৌন্দর্য। 
হজের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া ও আখিরাতের নানাবিধ কল্যাণের বিপুল সমারোহ ঘটিয়েছেন বলেই সে সব কল্যাণের অর্জনকে তিনি হজের লক্ষ্যমাত্রা ও মূলমর্ম হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। বিশ্ব মানবতার মুক্তির মহাসনদ, কালজয়ী গ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা হজের ২৬-২৮ আয়াতে বলা হয়েছে “স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীমের জন্য এই ঘরের স্থান ঠিক করেছিলাম- এ কথা বলে যে, এখানে শিরক করো না এবং আমার ঘর তওয়াফকারীদের ও নামাজিদের জন্য পাক-সাফ করে রাখ। আর লোকদের হজ করার জন্য প্রকাশ্যভাবে আহ্বান জানাও। তারা যেন তোমার কাছে আসে, হেঁটে অথবা কৃশ উঠের পিঠে চড়ে। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দীন ও দুনিয়ার কল্যাণের কত সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর দেয়া জম্ভগুলোকে আল্লাহর নামে কোরবানি করবে। তা থেকে নিজেরাও খাবে এবং অভাবগ্রস্ত লোকদেরও খেতে দেবে।” উপরোক্ত আয়াত তিনটি হতে স্পষ্ট বুঝা যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় ও দিক নির্দেশনাতেই খানায়ে কাবা নির্মিত হয়েছিল এবং সবাইকে এই কা’বা ঘর জিয়ারতের নির্দেশনাও আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন দিয়েছেন।
আল-কুরআনে বর্ণিত এ বাণী থেকে আমরা জানতে পারি, কিছু পরীক্ষা নেওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন হজরত ইব্রাহীম (আ.)-কে সারা বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদান করেন। হজের এ পবিত্র ভূমিতে এসেই আল্লাহর নবী ইবরাহীম ও ইসমাইল (আ.) তাদের নিজেদের জন্য ও অনাগত প্রজন্মের জন্য অনুগত মুসলিম হওয়ার দোয়া করেছিলেন, “হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এক আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে আপনার অনুগত জাতি বানান। আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদতের বিধি-বিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ [আল-বাকারাহ: ১২৮] বিশ্ব নেতৃত্ব পাওয়ার পর তিনি বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের দাওয়াতি কাজ সম্প্রসারণের জন্য তিন ব্যক্তিকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। 
তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র হজরত লুত (আ.) ২. তাঁর দ্বিতীয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) ৩. কনিষ্ঠ পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)। হজরত লুত (আ.)-কে দায়িত্ব দিলেন ট্রান্স জর্ডানের। হজরত ইসহাক (আ.)-কে দায়িত্ব দিলেন কেনান বা ফিলিস্তিনে এবং হজরত ইসমাইল (আ.)-কে দায়িত্ব দিলেন মক্কা নগরীতে। অবশেষে পিতা-পুত্র মহান আল্লাহর একান্ত নির্দেশেই কাবাগৃহ নির্মাণ করেন এবং বৈশ্বিক ইসলাম প্রচার কেন্দ্রে রূপ দেন।
হজরত ঈসা (আ.)-এর তিরোধানের পর থেকে হজের অনুষ্ঠানিকতায় বিকৃতি চলে আসে। একদা খানায়ে কা’বা মূর্তি দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আবার তওয়াফকারীরা উলঙ্গ হয়ে কাবা ঘরের তওয়াফ করতে থাকে। কোন এক সময় বোবা হজেরও প্রচলন হয়। এহেন বিকৃতি আল্লাহর পছন্দনীয় নয় সে কথাই জানানো হয়েছে উপরোক্ত নির্দেশনামায়। ছড়িয়ে আছে নানামুখী শিক্ষার মহাসমারোহ। সেসব শিক্ষা অর্জন করতে পারলে/হজের তাৎপর্য ও মর্মার্থ অনুধাবন করা সম্ভব হবে। হজের মৌলিক শিক্ষাই হলো, মহান আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল সাঃ প্রদর্শিত শরিয়তের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন ও পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ করা। আমাদের বুদ্ধি-বিবেক, চিন্তা-চেতনা ও আমলকে আল্লাহমুখী করা। আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্যে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করাই হলো, ইমানি চেতনার অনিবার্য দাবি। এদিকেই ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন, ‘তোমার রবের কসম! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তারা তোমাকে বিচারক নির্ধাক করবে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব করবে না এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেবে।” [আন্-নিসা : ৬৫] দ্বিধাহীন আনুগত্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হল হজ। 
হজের সেই পবিত্রভূমিসমূহে আজও তাই সম্মানিত হাজিগণের আগমন ঘটে নিরঙ্কুশ আনুগত্যের সে মহড়া দেয়ার জন্যই। আমীরুল মুমিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন দিতে গিয়ে এ দৃষ্টিভঙ্গিরই সার্থক প্রতিধ্বনি করেছেন এ কথা বলে যে, “নিশ্চয়ই আমি জানি তুমি একটি পাথর, তুমি কোন ক্ষতি করতে পার না এবং কোন উপকারও করতে পার না, রাসুল (সা.) তোমাকে চুম্বন করেছেন এটা যদি আমি না দেখতাম, তাহলে তোমাকে চুম্বন করতাম না।” [সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৪৯৪]
হাফিয ইবন হাজার রাহেমাহুল্লাহ বলেন, “উমার (রা.) এর এ উক্তির মধ্য দিয়ে দীনি ব্যাপারে শরিয়তের দ্বিধাহীন আনুগত্য এবং মর্ম ও নিগূঢ় তত্ত্ব বোধগম্য হচ্ছে না এমন বিষয়ে শরিয়তের সুন্দর অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ হলো। রাসুল (সা.) যা করেছেন যদি তার অন্তর্নিহিত মর্ম ও হিকমাত বোঝা নাও যায় তবু তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের অপরিহার্যতার ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে শরিয়তের মহান মূলনীতি।’ [ফাতহুল বারী]
গোটা মানব জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যেই হজের আয়োজন করেছেন আল্লাহ তায়ালা। মানুষকে লক্ষ্য করে তিন বলেছেন তোমরা শিরক করো না এবং আল্লাহর ঘর তওয়াফকারীদের জন্য পাক-সাফ রাখো। এ নির্দেশ দুটি নবীর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের দীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের কাফির-মুশরিকদের কুকীর্তির কথাই স্মরণ করে দেয়। হাজিরা মক্কা অভিমুখে রওনা হয়েই ঘোষণা করে হে আল্লাহ তুমিই আমাদের রব। তোমার দরবারে আমি হাজির হয়েছি। তোমার কোনো শরিক নেই। তোমার কাছেই আমাদের যাবতীয় প্রার্থনা। তুমিই আমাদের সব। সুদীর্ঘকাল ধরে হজের আনুষ্ঠানিকতা মুসলিম মানসকে করেছে সমৃদ্ধ, চেতনাকে করেছে উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত। ইবাদাতকে করেছে শুভামণ্ডিত এবং দৈনন্দিন জীবনকে করেছে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি শর্তহীন আনুগত। এভাবেই কাল ক্বিয়ামত পর্যন্ত হজের জান্নাতি দ্যুতি ছড়িয়ে পড়বে অনন্তকাল।

লেখক : সাংবাদিক

প্যানেল

×