ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘কিরীটি রায়’-এর জনক নীহার রঞ্জন গুপ্তের ১১৪তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ্য

রিফাত বিন ত্বহা, নড়াইল

প্রকাশিত: ১৪:৫৩, ৫ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৪:৫৬, ৫ জুন ২০২৫

‘কিরীটি রায়’-এর জনক নীহার রঞ্জন গুপ্তের ১১৪তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ্য

৬ জুন, বাংলা সাহিত্যের এক অমর ও অনবদ্য কথাশিল্পী, বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ‘কিরীটি রায়’-এর স্রষ্টা, জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নীহার রঞ্জন গুপ্তের ১১৪তম জন্মবার্ষিকী। বাংলার সাহিত্যে তাঁর অবদান অপরিসীম, বিশেষ করে রহস্য ও গোয়েন্দা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি এক অনন্য মাইলফলক। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নীহার রঞ্জন গুপ্তের সাহিত্যকর্ম আজও পাঠক হৃদয়ে অমলিন হয়ে আছে।

নীহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯১১ সালের ৬ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সত্যরঞ্জন গুপ্ত এবং মাতা লবঙ্গলতা দেবী। পিতার চাকরির সুবাদে শৈশব থেকেই গাইবান্ধা, রংপুর, কৃষ্ণনগরসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস ও শিক্ষা গ্রহণ করেন। রংপুর কার মাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক চিকিৎসক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল ব্যাপক। যুদ্ধকালীন সময় তিনি চট্টগ্রাম, বার্মা, মিশরসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চিকিৎসালয় গড়ে তোলেন এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পান। চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি সাহিত্যেও সমান দক্ষ ছিলেন তিনি।

নীহার রঞ্জন গুপ্তের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক অবদান ‘কিরীটি রায়’ চরিত্র। যুক্তিনির্ভর এই গোয়েন্দা চরিত্র বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টি করে। ‘কালোভ্রমর’ উপন্যাসে কিরীটির প্রথম আবির্ভাব ঘটে। সহচর সুব্রত কিরীটির তদন্ত কার্যক্রম লিপিবদ্ধ করেন, অনেকটা শার্লক হোমসের ওয়াটসনের মতো। বাংলা ছাড়াও বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই চরিত্রের গল্প। চলচ্চিত্র, নাটক ও রেডিও নাট্যরূপে জনপ্রিয়তা পেয়েছে কিরীটি।

গোয়েন্দা কাহিনির পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক বিষয়ও তাঁর সাহিত্যে উঠে এসেছে, যা পাঠক হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। দুই শতাধিক রচনার মধ্যে রয়েছে গোয়েন্দা গল্প, সামাজিক উপন্যাস, ও শিশুদের সাহিত্য। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রাজকুমারী’।

তাঁর বহু উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, যেমন ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘লালুভুলু’, ‘মেঘকালো’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’। ‘লালুভুলু’ উপন্যাসটি পাঁচটি ভাষায় চলচ্চিত্রায়িত হয়ে বহুভাষিক জনপ্রিয়তার নজির গড়েছে। থিয়েটারে ‘উল্কা’ উপন্যাসের মঞ্চায়নও ছিল ব্যাপক সাফল্যমণ্ডিত। শিশু সাহিত্য পত্রিকা ‘সবুজ সাহিত্য’র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করে শিশু সাহিত্যেও রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা।

নীহার রঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক নিবাস লোহাগড়ার ইতনা গ্রামে। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর পরিবার ছিল অগ্রণী। যদিও তাঁর পৈত্রিক বাড়িটি একসময় ভগ্নদশায় ছিল, ২০১৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সেটি সংস্কার করে এবং বর্তমানে তা সরকারের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত রয়েছে।

দেশভাগের পর পরিবার ভারতে চলে গেলে পাকিস্তান সরকার তাঁদের সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে বরেণ্য শিল্পী এসএম সুলতান তাঁর স্মৃতিতে নড়াইলে ‘শিশুস্বর্গ-২’ নামে একটি ফলক স্থাপন করেন। স্থানীয়দের দাবি, এই স্মৃতিকে আরও কার্যকরভাবে সংরক্ষণ ও চর্চা করা দরকার।

নড়াইল প্রেসক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি ও ফোকলোর গবেষক সুলতান মাহমুদ বলেন, “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতির মতো নীহার রঞ্জন গুপ্তের স্মৃতিকেও যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা উচিত।”

তিনি কেবল একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বা চিকিৎসক নন, ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তাঁর সৃষ্টি ‘কিরীটি রায়’ আজও পাঠকের হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানবিকতার এক অনন্য প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।

আজ তাঁর ১১৪তম জন্মবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি এই মহান সাহিত্যিককে। তাঁর সৃষ্টি ও অবদান চিরকাল আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর সাহিত্যকর্ম পৌঁছে দেওয়া এবং তাঁর স্মৃতিকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সংরক্ষণ করা আজ সময়ের দাবি।

মিমিয়া

×