
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস একটি জাতির সাহসী যাত্রার প্রতীক, যেখানে বহু সংগ্রাম এবং ত্যাগের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই ইতিহাস কেবল রাজনৈতিক উত্তরণের নয়, বরং বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদার পুনরুদ্ধারেরও গল্প।
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’
ছেলেবেলায় যখন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক কবিতার চরণগুলো পড়তাম, তখন মনে হতো তিনি হয়তো একটু বাড়িয়েই লিখেছেন। কিন্তু জীবনের পথপরিক্রমায় দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা থেকে এখন উপলব্ধি করি যে তিনি প্রকৃতপক্ষে অতিরঞ্জিত কোনো কথা বলেননি। আবহমানকালের ইতিহাস বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের সমসাময়িককালে আমাদের দেশ তথা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল অর্থনৈতিক শক্তির শীর্ষে।
আর মোগল আমলে সেই অবস্থান নেমে এসেছিল চতুর্থে। এর ফলে প্রাচীন আমলের সেই স্বর্ণযুগে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ এখানে এসেছে বাণিজ্যের অন্বেষণে। আবার কখনো কখনো তারা কূটকৌশল অবলম্বন করে এ দেশের শান্তিপ্রিয়, উদার, সরল-সাধারণ মানুষকে প্রবঞ্চিত করে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ দেশের জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রকৃতি—সবই ছিল মানব বসবাসের ক্ষেত্রে অনুকূল। আর তাই তো এ দেশের মানুষ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে।
এ দেশ আমাদের। দেশমাতৃকার পলিবাহিত মাটিতে জন্মগ্রহণ করে আমরা গৌরববোধ করি।
গর্বের কারণগুলো সংক্ষেপে :
১. প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস : আমাদের সভ্যতার ইতিহাস অতি প্রাচীন। সনাতন ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছিল এই ভূখণ্ডে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। তাই পশ্চিমা বিশ্বের মানুষকে যদি আমরা সভ্য বলি, তাহলে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধশালী জীবনের বাস্তবতা বিচার করে আমরা নিজেদের ‘সুসভ্য জাতি’ বলেই গর্ব করতে পারি।
২. প্রাকৃতিক ধন-সম্পদ ও সম্প্রীতি : এই ভূখণ্ড প্রকৃতির অবারিত দানে পরিপূর্ণ। জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ়। এত ছোট একটি ভূখণ্ডে বিপুল জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে স্বনির্ভরতা অর্জন করছি।
৩. ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য : ষড়ঋতুর এই দেশ আমাদের জীবন ও প্রকৃতিকে দিয়েছে এক অপরূপ রূপ এবং ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে জীবনের স্বাদ ও অনুভব।
৪. পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন : আমাদের পারিবারিক বন্ধন, মায়া-মমতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সহানুভূতি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের মধ্যেও বিরল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের এই পারস্পরিক সম্পর্কই বড় শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
উন্নয়নের পথে গর্বিত পদচারণা :
বর্তমান সরকারের গতিশীল পরিকল্পনায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। পদ্মা সেতু, বিদেশে ওষুধ রপ্তানি, কৃষিতে ছয় ফসলি পদ্ধতি কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অগ্রগতি—সবই গর্বের বিষয়। বিশেষ করে আইটি সেক্টরের উত্থান ভবিষ্যতের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল করছে।
নৈতিকতা ও আত্মিক উন্নতির প্রাসঙ্গিকতা :
যদিও উন্নয়নের পথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, কিছু নেতিবাচক বিষয় আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি, নারী-শিশু নির্যাতন ইত্যাদি সমস্যার মূল কারণ নৈতিকতার অভাব। উন্নয়নের এই গতি টেকসই করতে হলে আত্মিক ও নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আত্মা ও মনের সত্যিকারের তৃপ্তি আসে ভালো কাজ থেকে, সৎ পথ অবলম্বন থেকে।
বিশ্বখ্যাত ধনকুবের বিল গেটস তাঁর দানশীলতা থেকে যে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন, সেটাই প্রমাণ করে যে অর্থ নয়, বরং মানুষের কল্যাণই প্রকৃত শান্তির পথ। তেমনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকেও আত্মার শান্তি পেতে নিজের গণ্ডির মধ্যে থেকেই দায়িত্বশীলতা, সততা, দেশপ্রেম ও সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্যের চর্চা করতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা :
Lord Macaulay-এর ঐতিহাসিক বক্তব্যে যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের নৈতিক শক্তির স্বীকৃতি রয়েছে, তেমনি আমাদের বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করাও জরুরি। একটি সুখী, সুষম ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য এই নৈতিকতা অপরিহার্য।
আমরাও প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মো. শহীদুল্লাহর মতোই বিশ্বাস করি—
‘মাতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা—এই তিনটি জিনিস প্রত্যেক মানুষের কাছেই গৌরবের বস্তু।’
মিমিয়া