
ফিলিস্তিনের মুসলমান, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সহ পৃথিবীর নিষ্পেষিত নির্যাতিত অবহেলিত ও নিরন্ন মানুষগুলোকে উৎসর্গ করে এ লেখার অবতারণা করছি, যে কিনা তুচ্ছ কারণে জর্জরিত, কেউ বা বিনা দোষে শকুনের রোষানলে পড়ে অকালে জীবন দিতে হয়েছে। তারা যেন না ফেরার দেশে ও ভালো থাকে।
ঈদুল আজহা মানে আত্মত্যাগে নিমজ্জিত হওয়ার দিন। আজহা মানে ভোরের ঝিলিমিলি আলো, যা রাতের আঁধার ভেঙে নতুন সকাল নিয়ে আসে। কিন্তু মুসলমান যে আত্মপূজায় ডুবে আছি, আমরা কীভাবে অন্যকে আলোকিত করবো? আমাদের আত্মা তো স্বার্থের কালোয় কলুষিত। ঈদুল আযহা অন্ধকার নিমজ্জিত পৃথিবির বুকে আশার আলো জাগায়। নতুন করে বাঁচতে শিখায়। হতাশায় নিমজ্জিত জাতিকে সোনালি অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কেবল আত্মাৎসর্গের মাধ্যমেই যে পথবি নির্মাণ করা সম্ভব।
কুরবানি নিয়ে মন মাতানো বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কুরবানির মানবিক ও একই সঙ্গে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনা তুলে ধরেছেন। ভোগ-বিলাসে মত্ত মুসলমানদের আত্মত্যাগের চেতনায় জেগে ওঠার সবকও পাওয়া যায় 'কোরবানি', 'শহিদি ঈদ' ও 'বকরীদ' নামে নজরুলের এসব কবিতায়। পাপ-পঙ্কিলতায়, লোভ-লালসায় জর্জরিত বিশ্ব মুসলমানকে নজরুল বারবার বলেছেন, বনের পশুর সঙ্গে নিজ মনের পশুত্বকে কুরবানিক রে শুদ্ধ মানুষ হওয়ার সাধনা কর।
শুদ্ধ হওয়ার সাধনা করাই হলো নবী-রাসূলদের শেখানো সত্যিকারের কুরবানি। কুরআনে যে কোরবানির কথা হয়েছে, নজরুল সে কুরবানির কথাইব লেছেন ছন্দে ছন্দে- 'ইবরাহিমের কাহিনী শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?/আল্লাহরে পাবে মনে কর কুরবানি দিয়ে গরু-ছাগল? আল্লাহর নামে ধর্মের নামে, মানবজাতির লাগি পুত্ররে কুরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী? সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম কর তারে ঈদগাহে গিয়া তারি সার্থক হয় ডাকা আল্লাহরে। অন্তরে ভোগী বাইরে সে যোগী, মুসলমান সে নয় চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য সে পরিচয়।'
শুধু পশু কুরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব নয়। এটি অবাস্তব কল্পনা। এটি নজরুলের মনগড়া কথা নয়। কুরআনে বলা আল্লাহর ফরমান। সূরা হজের ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, 'লাইয়্যা নালাল্লাহা লুহুমুহা ওয়ালা দিমাউহা ওয়ালা কিন ইয়ানা এবং ৩৯ নং আয়াতে; লুহুত তাকওয়া মিনকুম তোমাদের জবাই করা পশুর রক্ত-মাংসের দিকে আল্লাহ ফিরেও তাকান না, তিনি দেখেন তোমাদের মনের তাকওয়া।' আল্লাহর ভয় ও প্রেম হৃদয়ে জাগ্রত না করে যত দামি ও সুন্দর পশুই কোরবানি করি না কেন- তা কখনোই আল্লাহ গ্রহণ করবেন না।
কুরবানির শিক্ষা হলো- মনের পশুকে জবেহ করে নিজেকে খোদায়ী রঙে সাজিয়ে তোলা। সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, মিথ্যা ও অধর্মের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে গর্জে ওঠা। এমন মুসলমানদেরই পবিত্র কুরআনে জীবন্ত শহিদ বলা হয়েছে। মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রাহিম (আ.) ও তদীয় পুত্র যেভাবে সর্বদা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন আমরাও যাতে সে এভাবে নিজেদের সর্বদা প্রস্তুত রাখি কবি তার কবিতায় সেই আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন। 'নির্যাতিতের লাগি পুত্রেরে দাও না শহিদ হতে, চাকরিতে দিয়া মিছে কথা কও 'যাও আল্লাহর পথে/বকরীদি চাঁদ করে ফরিয়্যাদ, দাওদাও কোরবানি, আল্লারে পাওয়া যায়না, করিয়া তাহার না-ফরমানি। 'নজরুল বলেছেন, মুসলমানের দায়িত্ব হল বিদ্বেষমুক্ত প্রেমের পৃথিবী গড়ে তোলা। যতদিন পর্যন্ত মুসলমান জাতি আত্মপূজা এবং স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে না পারবে ততদিন পর্য্যন্ত ন্যায়-ইনসাফ-সাম্যের পৃথিবী গড়ে উঠবেনা। স্বার্থপরের জন্য জান্নাত হারাম। নজরুল বলেছেন, 'শুধু আপনারে বাঁচায় যে মুসলিম নহে ভন্ড সে ইসলাম বলে বাঁচ সবাই/দাও কোরবানি জান ও মাল বেহেশত তোমার কর হালাল স্বার্থপরের বেহেশত নেই।'
যারা স্বার্থপর তাদের কুরবানি-নামাজ-রোজা সবকিছু লোক দেখানো ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। নজরুল এদের সেরা বে-দিন, শ্রেষ্ঠ কাফের বলেছেন। নজরুল বলেছেন, তোমরা ইসলামকে কবর দিয়ে আবার নিজেদেরও মুসলিম বলে গর্ব করছ। আরে, তোমাদের মতো পোশাকি ধার্মিক, লোক দেখানো কুরবানি দাতারাই তো ইসলামের গলায় ছুরি বসিয়ে ইসলাম নামের শাস্তি ও মুক্তির নৌকাটিকে ডুবিয়ে ফেলেছ। তারপর নজরুল বলেছেন, 'নামাজ-রোজার শুধু ভড়ং, ইয়া উয়া পরে সেজেছ সং, ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম! কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কর জড়, ত্যাগের বেলাতে জড়সড়।/তোর নামাজের কি আছে দাম?'
সত্যিই আজ মুসলমানের বড়ই দুর্দিন। অনেকেই আজ নিজেকে জাহির করতে কোরবানি দেয়। কেউ দেয় গোশতের লোভে আর কেউ সামাজিকতা রক্ষায়। প্রতিযোগিতা চলে কে কত বড় পশু কোরবানি দেবে? কার পশু সবার বাহবা কুড়াবে। হায়। ত্যাগের কোরবানি আজ ভোগের মদিরায় হারায়। জেনে রাখুন, আপনার কুরবানি যদি দুখী-অভাবী, নিঃস্ব-বানভাসি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, তবে এটি মহান রবের কাছে ছলনা ও ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব লোক দেখানো কুরবানিদাতা, স্বার্থপর মুসলমান ও পোশাকি ধার্মিকদের নজরুল নসিহত করে বলেছেন, বনের পশুর গলায় ছুরি চালানোর আগে নিজের মনে লুকিয়ে থাকা পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে নিজেকে মানুষ বানিয়ে নাও।
সাহিত্য ও সংবাদ-সাময়িকপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, একালে যেমন ঢাকার মাঠে-ময়দানে, রাস্তায়-রাস্তায় গরুর হাট বসে, সেকালে তেমনটি ছিল না। সেকালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল যেমন কম, কোরবানির পশুর সংখ্যাও ছিল তেমনি সীমিত। নির্দিষ্ট কিছু জায়গা যেমন রহমতগঞ্জ, গাবতলী, সোয়ারীঘাট ও জিঞ্জিরায় গরুর হাট বসত। বিশেষত ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনির নামে রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাটটি ছিল প্রসিদ্ধ। এই হাটের প্রচার কৌশলটিও ছিল বেশ চমকপ্রদ। হাটের ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে চিৎকার করে বলতেন, 'ধার করো, কর্জ করো, গনি মিয়ার হাট কর।' হাটে মুন্সিগঞ্জ জেলার মীরকাদিম বাজার থেকে আসত সাদা নাদুসনুদুস গরু। ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নজরুল জাতিকে আহ্বান জানালেন জান কোরবানের শপথ নিতে। নজরুল মনে করতেন ব্রিটিশ খেদানোটাই সবচেয়ে বড় কোরবানি।
তিনি মনে করতেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিক হিসেবে সম্মান নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ উৎসর্গের প্রতীকীনামই কোরবানি। তাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই ছিল নজরুলের চোখে কোরবানির প্রধান সার্থকতা- 'পশু কোরবানি দিস তখন আজাদ মুক্ত হবি যখন জুলুম মুক্ত হবে রেদ্বীন কোরবানির আজ এই যে খুন শিখা হয়ে যেন জ্বালে আগুন জালিমের যেন রাখে নাচিন আমিন রাব্বিল আলামিন। আমিন রাব্বিল আলামিন।'
এবার রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সংগঠনের অগণিত নেতাকর্মী ও সমর্থক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দীর্ঘদিন মায়ের হাতের খাবার তাদের ভাগ্যে জোটেনি। পবিত্র ঈদ উল আজহার দিনেও মায়ের হাতে গোস্ত রুটি থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হয়। সবাই নির্বিঘ্নে নিজ গৃহে পরিবারের সঙ্গে যেন ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে- এ ব্যবস্থাটি করার জন্য বাংলাদেশ সরকার, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। ঈদের সময় ও পক্ষ-বিপক্ষ তকমা দিয়ে কারও ওপর যেন হামলা করা না হয়। মনে রাখতে হবে- জীবন রক্ষা করা সবার অগ্রাধিকার। তারপর অন্নবস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা ও শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। আমি আশাবাদী এই ঈদে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না।
এবার আসছি ঈদুল আযহা কেন্দ্রীক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে। এই ঈদে আমার ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনে মাদক বিরোধী কর্মসূচিতে উপস্থিত হওয়ার রোডম্যাপ ছিল। অনিবার্য্য কারণে এ সময়ে আন্তর্জাতিক কর্মসূচি বাতিল করতে হয়েছে। পরিবর্তিত কর্মসূচি হিসেবে ৫ জুলাই হতে ১৫ জুলাই পর্যন্ত সম্পন্ন হতে পারে। আমার ইচ্ছে ছিল ঈদুল আযহার পর ময়মনসিংহ এ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক বিরোধী কর্মসূচি এ সশরিরে উপস্থিত থাকা। দেশের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে এ কর্মসূচিও বাতিল করতে হয়েছে। বাংলাদেশের নদী ও সামুদ্রিক অঞ্চলে সচেতনতার মাধ্যমে মাদক মুক্ত করতে পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে ৮ জুন হতে ১৩ জুন পর্য্যন্ত বাগেরহাট বরগুনা এবং ফিরোজপুর সময় কাটবে।
মানুষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার কুরবানি কীভাবে কবুল হবে আল্লাহর কাছে। ভেতর জগতে তুমিও একজন পশু, ওই অবলা জানোয়ারটিও এক পশুকে আরেক পশু কুরবানি দেওয়া কি হাস্যকর নয়। নজরুলের কবিতা দিয়েই শেষ করছি- 'পশু কোরবানি দিস তখন/আজাদ মুক্ত হবি যখন/জুল্ল মুক্ত হবে রে দ্বীন।' হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ভেতরকে নবুয়াতি রঙে, কুরআনের রঙে রাঙিয়ে দিন। সত্যিকারের কুরবানি করার তাওফিক নসিব করুন। আমিন।
পরিশেষে সবাইকে ঈদুল আযহার দাওয়াত দিয়ে এই প্রবন্ধের ইতি টানছি।
মোদের কোরবানি হোক স্রষ্টার তরে, সৃষ্টিকে দেখানো নয়, হারাম টাকায় নয়কো এবাদত হয়, হালাল টাকায় আমাদের যেন কুরবানিটা হয়। মেঘলা আকাশ বর্ষার দিন, ঈদের বাকি একদিন, আসবে সবার খুশির দিন, প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন পাড়া পড়শী গরিব দুঃখীর খবর নিন, দাওয়াত রইলো ঈদের দিন।
লেখক: ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন
প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
রিফাত