
ছবি: সংগৃহীত
কোনো রেকর্ড গড়ার উদ্দেশ্য নয়, না-ইবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া। ২০০ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে পাড়ি দেওয়ার এই গল্পটি একজন অসহায় বাবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার। রাজধানী ঢাকা থেকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ি পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে ছেলের জন্য উপহার নিয়ে ফেরেন রিকশাচালক মোহাম্মদ রাজু।
ছেলে রিজোয়ানকে মানুষের মতো মানুষ করতে চান রাজু। রক্ত-ঘাম ঝরানো কষ্টের টাকায় একটি সাইকেল কিনেছেন ছেলের জন্য। কিন্তু ঢাকা থেকে গাইবান্ধা পর্যন্ত সাইকেল পরিবহনের খরচ জোগাড় করতে না পেরে শেষ ভরসা হিসেবে নিজের পরিশ্রমকেই বেছে নিয়েছেন তিনি।
ছেলের জন্য কেনা সাইকেলসহ গাইবান্ধায় ফেরার জন্য পরিবহন খরচ প্রয়োজন ছিল প্রায় ৩ হাজার টাকা। কিন্তু রাজুর হাতে ছিল মাত্র ২২০০ টাকা। এই টাকাতেই পরিবার চালাতে হবে, ঈদের খরচ মেটাতে হবে— তাই সাইকেলসহ বাসে করে ফেরা তাঁর জন্য সম্ভব হয়নি।
রাজু বলেন,
“আমি চিন্তাভাবনা করিয়া খাটিখুটি করিয়া কিছু টাকা সংসারে দিয়া, তারপরে কিছু টাকা আমার পোলার লাইগা ব্যবস্থা করিয়া, একটা ছোট সাইকেল কিনছিলাম। আব্দুল্লাহপুরে গিয়া দেখি বাসে সাইকেলসহ টিকিট চায় ২ হাজার টাকা। আমার হাতে আছে ২২০০ টাকা। টিকিট কিনলে পোলাপান খাইবো কি?”
এই অবস্থায় রাজু সিদ্ধান্ত নেন, সাইকেল চালিয়ে নিজেই বাড়ি ফিরবেন। বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটায় ঢাকার আব্দুল্লাহপুর থেকে রওনা হন তিনি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে রাত নামে, ক্লান্তি চেপে বসে শরীরে, কিন্তু থেমে যাননি রাজু। বগুড়ায় পৌঁছাতে সময় লেগে যায় ২১ ঘণ্টা। একপর্যায়ে মহাসড়কে মধ্যরাতে চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে তল্লাশির জন্য থামায়। তখনই রাজুর কষ্টের কথা জানতে পারেন তারা।
রাজুর পরিস্থিতি শুনে সহানুভূতিশীল হন দায়িত্বরত সেনা সদস্যরা। তারা একটি ট্রাকে করে রাজু ও তার ছেলের সাইকেল গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সঙ্গে তাকে খাবারের জন্য কিছু শুকনো খাদ্যদ্রব্যও দেন। সামান্য একবেলার খাবারে রাজুর কণ্ঠে তখনও কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে,
“এই যে আজকে বগুড়া স্ট্যান্ডে আইসা দম নিয়া একটা রুটি গলা দিয়া খাইয়া আমি আবার রওনা দিলাম। সেনাবাহিনীর ভাইয়েরা আমারে খাইতে দিছে, সাহায্য করছে।”
শত শত নেতিবাচক খবরের ভিড়ে রাজুর গল্প আশার আলো দেখায়। কিন্তু একইসঙ্গে এ প্রশ্নও ছুড়ে দেয়— স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও একজন দিনমজুর বাবা কেন সন্তানের জন্য কিনে আনা একটি সাইকেল বাড়ি নিতে পারেন না? কেন রাষ্ট্রের সিস্টেম তার পাশে দাঁড়ায় না, এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা কি ক্রমেই কমে আসছে?
রাজুর এই গল্প নিছক করুণার নয়, এ এক অনুপ্রেরণার গল্প, এক মানবিক দায়বদ্ধতার প্রতিচ্ছবি।
ভালো থাকুক রিজোয়ান। ভালো থাকুক তার বাবা রাজু।
ভালো থাকুক এই সমাজের সব রাজুরা, যারা সীমাহীন ভালোবাসা নিয়েই প্রতিদিন বাঁচে।
আঁখি