
ছবি: সংগৃহীত
ঈদুল আযহা মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবগুলোর একটি। আরব দেশগুলোতে এই ঈদ শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, বরং পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক বিরাট উদ্যাপন। কোরবানির মাংস কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া নানাবিধ খাবার এই উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। দেশের পর দেশ পেরিয়ে প্রতিটি অঞ্চলে গড়ে উঠেছে নিজস্ব ঈদীয় খাদ্য ঐতিহ্য।
ঐতিহাসিক লিনা হামদান বলেন, ‘ঈদের বিশেষ খাবার ও ঈদিয়া বিতরণ ইসলামি সভ্যতার প্রাচীন ধারাবাহিকতা।’ তিনি জানান, দশম শতকের ফাতেমি যুগে ঈদের দিনে উপহার বিনিময় ছিল সামাজিক রীতি।
চলুন, ঘুরে আসা যাক আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদুল আযহার দস্তরখানা—
মিসর: ফাত্তা ও কাব্দা ইস্কান্দারানি
মিসরে ঈদ মানেই রাস্তায় কোরবানি, বাড়ির সামনে জবাই, আর টেবিলে ‘ফাত্তা’। কোরবানির মাংস, চাল, রুটি, মসলাদার ঝোল ও সিরকা-রসুনে তৈরি এই খাবারটির শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় ফারাওনিক যুগে।
ঈদের সকালের নাশতায় থাকে 'কাব্দা ইস্কান্দারানি'—আলেকজান্দ্রিয়ান স্টাইলে তৈরি মসলা ও পেঁয়াজে ভাজা কলিজা। সঙ্গে পাতলা রুটি ‘রাক্কাক’, যা উসমানিয়া যুগে জনপ্রিয় হয়।
সিরিয়া: শাকরিয়া ও সিরিয়ান ফাত্তা
সিরিয়ার ঈদের প্রধান পদ ‘শাকরিয়া’। দই, কোরবানির মাংস, মসলা ও স্টার্চে তৈরি এই খাদ্যটি পরিবেশন করা হয় ভাত বা বুলগুরের সঙ্গে। হামদানের মতে, এক সিরিয়ান মা তাঁর ছেলের নামে প্রথম এ খাবারটি তৈরি করেন—সেই থেকে এ নাম।
ঈদের সকালে পরিবেশিত হয় ‘তাসকিয়া’ বা সিরিয়ান ফাত্তা—দই, রুটি ও মাংসের ঐতিহ্যবাহী মিশেল। ইবনে জাওজির লেখায় আব্বাসি যুগে দরিদ্রদের মধ্যে এমন খাবার বিতরণের উল্লেখ রয়েছে।
লেবানন: তাব্বুলা ও মালুখিয়া
লেবাননের দস্তরখানায় সবচেয়ে পরিচিত নাম ‘তাব্বুলা’। পার্সলে, টমেটো ও বুলগুর দিয়ে তৈরি এই স্বাস্থ্যকর সালাদই উৎসবের হালকা ও সতেজ দিকটি তুলে ধরে। আর আছে ‘মালুখিয়া’—জুটপাতার তরকারি।
ঐতিহাসিক মাকরিজি লিখেছেন, ফাতেমি যুগে লেবাননের উৎসবে সালাদ ও মাংসের মিশ্রণ ছিল অবিচ্ছেদ্য। আজও পারিবারিক মিলনের মাধ্যমে ঈদের খাবার ভাগাভাগি সেখানে এক সামাজিক ঐক্যের চিহ্ন।
জর্ডান: মানসাফ ও মাকলুবা
জর্ডানে ঈদের মূল আকর্ষণ ‘মানসাফ’—কোরবানির মাংস, ভাত ও জামিদ (শুকনা দই) দিয়ে তৈরি এই পদকে বলা হয় জর্ডানের জাতীয় খাবার।
আরেকটি ঐতিহ্যবাহী পদ ‘মাকলুবা’—যা চাল, মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি হয়। ঈদিয়া দেওয়ার প্রথাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ; ছোটদের নগদ অর্থ ও নারীদের উপহার দেওয়া হয় ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে।
ইরাক: দোলমা ও মাসগুফ
ইরাকের খাবার টেবিলে ‘দোলমা’ অপরিহার্য। পেঁয়াজ, টমেটোসহ নানা শাকসবজির ভেতরে মাংস, চাল ও মসলা ভরে তৈরি হয় এটি। আর আছে ‘মাসগুফ’—গ্রিল করা মসলাদার মাছ, যা ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস কেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রতীক।
ইবনে জাওজি উল্লেখ করেছেন, আব্বাসি যুগে এ ধরনের মাছ ও মাংস বিতরণ হতো দরিদ্রদের মাঝে।
মরক্কো: বোলফাফ ও ওসবান
মরক্কোর ঈদের জনপ্রিয় খাবার ‘বোলফাফ’—দম্বার কলিজা কয়লার আগুনে ভেজে, মসলা মেখে চর্বির মধ্যে মুড়িয়ে আবার ভাজা হয়। অন্যদিকে ‘ওসবান’ তৈরি হয় পশুর ভুঁড়ির মধ্যে আলু, বেগুন, কুসকুস ও মাথার মাংস পুরে।
হামদানের মতে, ওসবান মাগরিব অঞ্চলের একটি আদি খাবার যা গ্রাম্য জীবন ও সামাজিক উৎসবের অংশ।
উপসাগরীয় দেশ: কাবসা ও মাকলাই
সৌদি আরব, কাতার ও আমিরাতে ঈদের সবচেয়ে পরিচিত খাবার ‘কাবসা’—মাংস, চাল, জাফরান ও দারুচিনির মিশ্রণে তৈরি এই পদ গোটা উপসাগরীয় সংস্কৃতির প্রতীক।
ঈদের সকালে খাওয়া হয় ‘হারিস’ (গম ও মাংসের পোরিজ), ‘মাজবুস’ (মসলাদার ভাত ও মাংস) ও ‘সারিদ’ (রুটি ও মাংসের স্যুপ)। কলিজা ও প্লীহা গ্রিল করে বানানো ‘মাকলাই’ অনেকেই পছন্দ করেন।
ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে উপসাগরীয় অঞ্চলে ঈদের দিন এ ধরনের সুগন্ধি মসলার খাবারের প্রচলনের কথা তুলে ধরেছেন।
ঐতিহ্য, ত্যাগ আর খাবারের আনন্দ
ঈদুল আযহা আরব বিশ্বে শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়—এটি সামাজিক বন্ধন, আতিথেয়তা ও ঐতিহ্যের মিলনমেলা। শতাব্দীপ্রাচীন ইসলামি রীতিনীতির ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা এসব খাবার প্রতিটি জাতির সংস্কৃতির স্বাদ বহন করে।
ফাত্তা থেকে মানসাফ, শাকরিয়া থেকে কাবসা—এসবই কেবল পদের নাম নয়, বরং এগুলো একেকটি অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভালোবাসার স্বাক্ষর।
সূত্র: আল জাজিরা।
রাকিব