
ছবি: সংগৃহীত
প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মুসলিম বিশ্ব ঈদুল আযহা পালন করে। এই দিনটি শুধুমাত্র পশু কোরবানির অনুষ্ঠান নয়; বরং এটি এক গভীর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার দিন, যা হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য এবং আত্মত্যাগের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
কোরবানির সূচনা মূলত হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সময় থেকে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি আদেশ পান তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি দেওয়ার জন্য। নিঃসন্দেহে এটি ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম বড় আত্মত্যাগের পরীক্ষা। পিতার আদেশ ও আল্লাহর হুকুম মেনে হযরত ইসমাঈল (আ.) নিজেকে উৎসর্গ করতে রাজি হন। এই আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তাঁদেরকে একটি জান্নাতি পশু দিয়ে ইসমাঈলের পরিবর্তে কোরবানি কবুল করেন। এই ঘটনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর জন্য কোরবানি ওয়াজিব হয়, যা আত্মত্যাগ, আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাসের নিদর্শন।
কোরবানি মানে কেবল পশু জবাই নয়—এটি এক প্রতীক। পশুকে আল্লাহর নামে জবাই করার মাধ্যমে মানুষ শেখে নিজের ‘নফস’ বা আত্মমোহ ত্যাগ করতে। আমাদের অহংকার, লোভ, হিংসা, ক্রোধ, অন্যায় আকাঙ্ক্ষা—এসবই আসল কোরবানির বিষয়। বাস্তব জীবনে কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা তখনই সফল হয়, যখন আমরা মনের পশুকে কোরবানি দিতে শিখি।
হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কাহিনি শুধু ঐতিহাসিক স্মৃতি নয়, এটি মুসলমানদের জন্য এক চলমান শিক্ষার বার্তা। আল্লাহর আদেশ পালন করতে গিয়ে কোনো প্রকার প্রশ্ন না করে, দ্বিধা না রেখে, তিনি যেভাবে তাঁর সন্তানকে উৎসর্গে প্রস্তুত ছিলেন—তা আমাদের শেখায় যে ঈমানদারের জীবনে আল্লাহর আদেশ সর্বোচ্চ। আজকের যুগে এই শিক্ষা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, নৈতিকতা ও ন্যায়বোধে প্রয়োগ করা উচিত।
ঈদুল আযহার দিনে প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখা—আমি কি সত্যিই আল্লাহর হুকুম মানি? আমি কি নিজের লোভ, অন্যায় অভ্যাস, ক্ষতিকর চিন্তা বা আচরণকে ত্যাগ করতে পারি? কোরবানির পশু জবাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমি আমার ভেতরের খারাপ দিকগুলোকেও "জবাই" করতে পারি, তবেই কোরবানির প্রকৃত অর্থ পূরণ হবে।
কোরবানির শিক্ষা শুধু আত্মিক নয়, সামাজিকও। কোরবানির মাংস তিন ভাগে বিভক্ত করে দরিদ্র ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বণ্টনের নির্দেশ রয়েছে। এটি আমাদের শেখায় সমাজে সমতা, দানশীলতা এবং মানবিকতা। ঈদের আনন্দ যেন একা ভোগ না করি, বরং তা যেন সবার মাঝে ছড়িয়ে দিই—এটাই কোরবানির চেতনার অন্যতম দিক।
বর্তমান ভোগবাদী ও স্বার্থকেন্দ্রিক সমাজে কোরবানির এই মর্মবাণী আরও বেশি জরুরি। যেখানে মানুষ নিজস্ব লাভ ও সুবিধাকে বড় করে দেখে, সেখানে আত্মত্যাগের আদর্শ আমাদের নতুন করে ভাবায়। শুধু রীতিমতো পশু জবাই করে দায়িত্ব শেষ নয়; বরং সেই কোরবানিকে আমাদের আচরণে, নৈতিকতায় এবং অন্যের জন্য ত্যাগের মানসিকতায় পরিণত করাই হবে প্রকৃত ঈমানদারের পরিচয়।
ঈদুল আযহা আমাদের শেখায়, আল্লাহর ভালোবাসা ও নির্দেশ মানার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত। এটি আত্মত্যাগ ও আনুগত্যের এমন এক অনন্য পাঠ, যা কেবল উৎসবে সীমাবদ্ধ নয়—বরং প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি ত্যাগে এই শিক্ষা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
আসুন, আমরা কোরবানির পশুর সাথে সাথে আমাদের অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ, কৃপণতা ও অন্যায়কেও কোরবানি দিই। তাহলে প্রকৃত অর্থে ঈদুল আযহার স্বার্থকতা আমরা লাভ করতে পারব।
মুমু ২