ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পাঞ্জাবের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিন্নধর্মী ঈদ

মোঃকারিমুল হাসান,চন্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়,পাঞ্জাব,ভারত

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ৭ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৭:২৯, ৭ জুন ২০২৫

পাঞ্জাবের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিন্নধর্মী ঈদ

ক্যালেন্ডারের পাতায় ঈদের দিন। বাংলাদেশের বাড়ির প্রতিটি কোণ হয়তো আজ আলোয় ভরে উঠেছে। মসজিদের দিক থেকে ভেসে আসছে তাকবিরের ধ্বনি, রান্নাঘর থেকে গরুর মাংসের ঘ্রাণ, আর মা-বাবার মুখে হাসির ছটা। অথচ আমি—বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে, ভারতের পাঞ্জাবের একটি শহরে, পড়াশোনার কারণে পরিবারহীন অবস্থায় ঈদ পালন করছি।

সকালে ঘুম ভাঙলো মায়ের ফোনে। মায়ের কণ্ঠস্বরের মমতা যেন ঘুম জড়ানো মনটাকে মুহূর্তেই জাগিয়ে দিল। “ঈদ মোবারক মা, কী খবর?” —মায়ের নরম কণ্ঠস্বর আর ঈদের দোয়া শুনতে শুনতে চোখের কোণে অজান্তেই পানি চলে এলো। কষ্ট করে হাসিমুখে কথা শেষ করলাম।

তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিকটবর্তী মসজিদের দিকে রওনা দিলাম। ঈদের নতুন পাঞ্জাবি পরে একটু হলেও মনটা ফুরফুরে লাগছিল। মসজিদে পৌঁছে দেখি চেনা-অচেনা অনেক প্রবাসী মুসল্লি, সবার চোখেমুখে কিছুটা উচ্ছ্বাস, কিছুটা শূন্যতা। ঈদের নামাজ শেষে আলিঙ্গন আর কোলাকুলি—তবে প্রতিটা ঈদ মোবারকেই যেন অভাব অনুভব করছিলাম আমার বাবা-মায়ের, বড় বোন আর আমাদের বাড়ির।

নামাজ শেষে ফিরে এলাম বাসায়। কয়েকজন বন্ধু মিলে রান্নায় হাত লাগালাম। খাসির মাংস, পোলাও, আর সেমাই—চেষ্টা করছিলাম যেন মনটা একটু ব্যস্ত থাকে। দুপুরে একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষে, আবার ফোনে মেসেজ, ভিডিও কল—পরিবার, বন্ধু, আত্মীয় সবার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়।

সব শেষ করে ভাবলাম একটু সময় ল্যাপটপে কাজ করি। সামনে একটা গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান প্রজেক্ট জমা দিতে হবে, সময় কম। প্রোগ্রামিং করতে বসে মনটাকে কাজে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম। কয়েক ঘণ্টা পর হঠাৎ চোখ পড়লো মোবাইল স্ক্রিনে—ফেসবুক খুলতেই দেখি সবাই ঈদের ছবি দিচ্ছে—বাবার সাথে নামাজে, মায়ের হাতের রান্না, ভাইবোনদের হাসি। হৃদয়ের গভীরে হঠাৎ যেন একটা শূন্যতা হু হু করে উঠলো। স্মৃতির পাতা খুলে গেল—সেই ছোটবেলার ঈদ, যখন বাবা হাত ধরে নিয়ে যেতেন ঈদের নামাজে, নামাজ শেষে বাবা বলতেন, “এবার তোমার দায়িত্ব গোশত কাটা আর বিলি করা।” কী আনন্দে কেটে যেত সেই দিনগুলো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। যদি ঈদটা এবার বাড়িতেই হত... হয়তো মা বলতো, “আরও একটা রুটি খা”, বাবা বলতেন, “যাও, তোমার আন্টির বাসায় একটু গোশত দিয়ে আসো।” বড় বোনটা হয়তো কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরতো—"ভাইয়া, আর বাইরে পড়তে যেও না।”

তবে মন খারাপ করে বসে থাকলে চলবে না। মাথায় চাপা দিচ্ছে প্রজেক্ট জমা দেয়ার ডেডলাইন। আবার ল্যাপটপ খুলে কাজ শুরু করলাম।

বিকেলে ক্যাম্পাসে দেখা হলো বাংলাদেশি ভাইদের সাথে। পাঞ্জাবে থাকা অন্য স্টুডেন্টরা সবাই আজ একত্রিত হয়েছে। ছোট ভাইয়েরা, বড় ভাইয়েরা, কাছের বন্ধুরা—সবাই মিলে আড্ডা, গল্প, গান করা । পরিবারের অভাবটা এরা যেন কিছুটা ভুলিয়ে দিলো। কারও ব্যাগ থেকে বের হলো  মিষ্টি, কেউ এনেছে নিজের তৈরি সেমাই। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমরা সবাই হয়তো ভিন্ন দেশে, কিন্তু একে অপরের জন্য একটা ছোট্ট পরিবার।

রাত নামলো ধীরে ধীরে। সবাই মিলে একসাথে খাবারের আয়োজন করলাম—রুটি, মাংস, দই। খাওয়ার পরপরই মা, বাবা, আর আপুর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হলো। যতবার বলছি, “ভালো আছি মা,” ততবারই চোখটা ছলছল করছে। তারা কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। আমার দেশের প্রতি ভালোবাসা, পরিবারের প্রতি টান—সবই যেন এক ফ্রেমে বন্দি হয়ে গেল সেই ভিডিও কলে।

এই ছিল আমার প্রবাসের ঈদ। পরিবার ছাড়া হলেও, মনটা ভালো রাখার চেষ্টা করেছি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। ঈদ মানেই তো খুশি, ত্যাগ আর ভালোবাসার মেলবন্ধন। আর এই ভালোবাসাই হয়তো দূর দেশে থেকেও আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, কাজের প্রেরণা দেয়, আর বলে—তুমি একা নও, পৃথিবীর যেখানেই থাকো, তুমি আছো ভালোবাসার এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা।

মোঃকারিমুল হাসান, সি এস ই, ৪র্থ বর্ষ,  চন্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, পাঞ্জাব, ভারত।

সাব্বির

×