
ছবি: সংগৃহীত
বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কিংবা পারিবারিক গেট টুগেদারে এমন অনেকেই পড়েছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে, যখন আশপাশের মানুষজন নানা উটকো প্রশ্নে জর্জরিত করে। "এখনো বিয়ে করোনি কেন?", "তুমি এত মোটা হয়ে গেছো কেন?", "তোমার বেতন কত?", "তুমি এত কালো কেন?"— এই ধরনের প্রশ্ন যেন কিছু মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এসব প্রশ্ন করার সময় তারা একবারও ভাবেন না, এগুলো কাউকে মানসিকভাবে কতটা কষ্ট দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের প্রশ্ন আসলে একজনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ। অনেকেই এগুলোর পেছনে সদিচ্ছা দেখালেও মূলত এসব তথ্য সংগ্রহ করে পরবর্তীতে গুজব ছড়ানো বা সুযোগমতো মানসিক চাপ সৃষ্টি করাই তাদের উদ্দেশ্য থাকে।
মানবজীবনের গভীরতা নিয়ে চিরন্তন সত্য তুলে ধরেছেন ইরানের প্রখ্যাত সুফি সাধক ও কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। প্রায় ৭০০ বছর আগে তিনি মানুষকে সচেতন করে গেছেন কিছু বিষয়ে সবসময় নীরব থাকার জন্য। জীবনে স্বস্তি ও সফলতা পেতে তিনি বিশেষ তিনটি বিষয়ে কাউকে কিছু না বলার উপদেশ দিয়েছেন।
প্রথম উপদেশ: আপনার জীবনযাপন পদ্ধতি কাউকে ব্যাখ্যা করবেন না রুমি বলেন, প্রত্যেকেই তার জীবন নিজের মত করে সাজিয়ে নেয়। কারো পছন্দ শহরের কোলাহল, কারো পছন্দ গ্রামের শান্ত প্রকৃতি। কেউ উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে ঝামেলামুক্ত ছোট চাকরি বেছে নেন। এসব সিদ্ধান্ত একান্তই ব্যক্তিগত। আপনি যদি বারবার আপনার সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করেন, তাহলে তা আপনার দুর্বলতা প্রকাশ করে এবং সমালোচকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়।
রুমি মসনবীতে অন্ধদের হাতি দেখার গল্প দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন—মানুষ সবকিছু পুরোপুরি বোঝে না, শুধুমাত্র তার অনুভব ও উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করে বিচার করে। তাই কে কি বলল তাতে কান না দিয়ে নিজের পথে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
দ্বিতীয় উপদেশ: আপনার সম্পর্কের সীমারেখা নিয়ে আলোচনা করবেন না মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে তা একান্তই আপনার বিষয়। কারো সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন কিনা, তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধুমাত্র আপনার। এ বিষয়ে অন্যদের ব্যাখ্যা দিলে তারা তা ভুল ব্যাখ্যা করে আপনাকেই বিপদে ফেলতে পারে।
প্রাচীন চিকিৎসক গ্যালেনের একটি গল্প দিয়ে রুমি বোঝান, কিছু সম্পর্কের উপস্থিতি আমাদের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে, এবং কখনো সেগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। তবে সে সিদ্ধান্ত কেবল আপনার, অন্যের ব্যাখ্যার জন্য নয়।
তৃতীয় উপদেশ: আপনার আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবেন না রুমি মাসনবীতে একটি গল্পে বলেন, হাঁসের ডিম মুরগির নীড়ে দিলে যেমন সেটি তার প্রকৃতি অনুযায়ী পানিতে সাঁতার কাটে, তেমনি মানুষও তার প্রকৃতি অনুযায়ী জীবনযাপন করে। তাই আপনার ব্যক্তিগত স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কিংবা লক্ষ্য সম্পর্কে সবাই জানলে তারা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, সমালোচনা করবে এবং আপনাকে বিভ্রান্ত করবে।
নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকা এবং তাতে আত্মবিশ্বাস রাখা—এটাই সঠিক পথ। অপরের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে গেলে নিজের শান্তি হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
শেষ কথা, আজ যদি আপনি নিজেকে অপরের মন্তব্য থেকে বাঁচাতে নিজের অবস্থান পাল্টান, তাহলে কালকে তারা আরও বেশি সাহস পাবে। কিন্তু আজ যদি আপনি নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকেন, ভবিষ্যতে তারা আপনাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস হারাবে।
মাওলানা রুমির একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করা যায়: “গতকাল আমি বুদ্ধিমান ছিলাম, তাই পৃথিবীটাকে বদলাতে চেয়েছিলাম। আজ আমি জ্ঞানী, তাই নিজেকে বদলাতে চাই।”
ভিডিও দেখুন: https://www.youtube.com/watch?v=EvUV6imRjuo
এম.কে.