
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নিষ্পেষিত, দূষণে জর্জরিত, আর টেকসই উন্নয়নের পথে সংগ্রামরত বাংলাদেশ আজ প্রকৃতির সাথে তার অস্তিত্বের লড়াইয়ে নিয়োজিত। ভৌগোলিক কারণ বিবেচনায় এই বৃহত্তম ব-দ্বীপ সবসময়ই জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁকির মুখোমুখি। প্রকৃতির মরণচিৎকার উপেক্ষা করে, পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে কখনই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে জয় লাভ সম্ভব নয়। তাই এক্ষেত্রে পরিবেশকে রক্ষা করে তার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া অতীব জরুরি। তবে সেক্ষেত্রে নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বাংলাদেশ।
জলবায়ু পরিবর্তন:
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব এখানে প্রত্যক্ষ ও ভয়াবহ।
জাতিসংঘের জলবায়ু প্যানেল (আইপিসিসি) এবং বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের গবেষণা অনুসারে, ১ মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশের প্রায় ১৭% ভূমি (কক্সবাজার, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিশাল অংশ) তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন।
ঘূর্ণিঝড় (আইলা, সিডর, আম্পানের ধ্বংসযজ্ঞ স্মরণীয়), আকস্মিক বন্যা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং খরার তীব্রতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালের সিলেট ও সুনামগঞ্জের ভয়াবহ বন্যা এবং ২০২৪ সালের উত্তরাঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী খরা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। বিশ্বব্যাংকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জিডিপির ২% পর্যন্ত ক্ষতি করতে পারে। সমুদ্রের নোনা পানি উপকূলীয় নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে অনুপ্রবেশ করে কৃষিজমি ও পানীয় জলের উৎসকে অনুর্বর করে তুলছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ধান ও অন্যান্য ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ইতোমধ্যেই উপকূলীয় ও নদীভাঙন এলাকা থেকে লক্ষাধিক মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, যাদের অধিকাংশই শহরাঞ্চলের বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছেন, নগর পরিকাঠামো ও সামাজিক সেবার উপর চাপ সৃষ্টি করছেন।
দূষণ:
জলবায়ু পরিবর্তনের ত্রিমুখী সংকটে নাকাল নগর ও গ্রাম। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি দূষণ বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ আঞ্চলিক সংকট।
বায়ু দূষণ: বিশ্ব বায়ু মান প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর শীর্ষে বা তার কাছাকাছি অবস্থান করছে। যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটার কালো ধোঁয়া (৩৫০০+ অবৈধ ইটভাটা), নির্মাণকাজের ধুলা, আবর্জনা পোড়ানো এবং শিল্পকারখানার নির্গমন এর প্রধান উৎস। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় শহরের বাতাসে ক্ষতিকর পিএম২.৫ এর মাত্রা প্রায়ই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশকৃত মাত্রার ১০ গুণেরও বেশি পাওয়া যায়। এর ফলে শ্বাসযন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং অকাল মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
পানি দূষণ: জীবনরেখার মরণরোগ: দেশের প্রায় সব প্রধান নদী (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী, হালদা) শিল্পবর্জ্য, অপরিশোধিত পয়ঃনিষ্কাশন, কৃষি থেকে আসা কীটনাশক ও সার এবং প্লাস্টিক বর্জ্যে মারাত্মকভাবে দূষিত। পরিবেশ অধিদপ্তরের (ডিওই) রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি জীবাণু ও রাসায়নিক দূষণের মাত্রা মানব ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী। ভূগর্ভস্থ পানিতেও আর্সেনিক দূষণ (প্রায় ২ কোটি মানুষ ঝুঁকিতে) এবং ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি।
প্লাস্টিক দূষণ: বাংলাদেশ প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চরম সংকটে রয়েছে। প্রতিদিন উৎপাদিত প্রায় ৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৩০-৫০% কোনো রকমে সংগ্রহ করা হয়, এবং এর খুব সামান্যই পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বাকি প্লাস্টিক নদী-নালা, খাল-বিল, ড্রেন ও সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের (যেমন: পলিব্যাগ, কাপ, স্ট্র) অত্যাধিক ব্যবহার এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা: এ যেন অর্জন ও পিছিয়ে থাকার দ্বন্দ্ব। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে জলবায়ু ও পরিবেশগত লক্ষ্যগুলো (বিশেষ করে লক্ষ্য ১৩: ক্লাইমেট অ্যাকশন, লক্ষ্য ১৪: পানির নিচের জীবন, লক্ষ্য ১৫: স্থলজ জীবন) বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এসডিজি লক্ষ্য ১৩ (ক্লাইমেট অ্যাকশন): অভিযোজন (Adaptation) প্রচেষ্টা যেমন: বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি, লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী, বিশেষ করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অংশগ্রহণের ফলে সেটি সম্ভব হয়েছে। তবে প্রশমন (Mitigation) কার্যক্রম যেমন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানো তুলনামূলক দুর্বল। শিল্পায়ন, দ্রুত নগরায়ণ ও জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা (বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিকল্পনা) নির্গমন বৃদ্ধির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এসডিজি লক্ষ্য ১৪ (পানির নিচের বাস্তুতন্ত্র): নদী ও সামুদ্রিক দূষণ (বিশেষ করে প্লাস্টিক ও শিল্পবর্জ্য), অত্যধিক মৎস্য আহরণ এবং বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস (যেমন: ম্যানগ্রোভ বন উজাড়) এই লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় বাধা। এতে করে সাগরে মাছের প্রাচুর্য হ্রাস পাচ্ছে, ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ছে।
এসডিজি লক্ষ্য ১৫ (ভূমি এবং তার পরিবেশ): জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কৃষিজমির সম্প্রসারণ এবং অবৈধ গাছ কাটার ফলে বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। সংরক্ষিত এলাকাগুলোর সুরক্ষাও চ্যালেঞ্জের মুখে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণ কৃষি উৎপাদন (লক্ষ্য ২), জনস্বাস্থ্য (লক্ষ্য ৩), দারিদ্র্য বিমোচন (লক্ষ্য ১) এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (লক্ষ্য ৮) অর্জনকেও বাধাগ্রস্ত করছে, এসডিজির সার্বিক অগ্রগতি ঝুঁকির মুখে ফেলছে। যার কারণ অপরিকল্পিত কার্যক্রম এবং আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা।
জলবায়ু নীতি ও শাসন: উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও এর বাস্তবায়নের বিশাল ফারাক এখানে লক্ষণীয়।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বেশ কিছু নীতিগত কাঠামো ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
-
বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি): জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও অভিযোজনের জন্য প্রাথমিক রোডম্যাপ। এর আপডেট সংস্করণে প্রশমনকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
-
ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (ন্যাপ): জলবায়ু অভিযোজনকে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেটে মূলধারায় আনার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা। এর বাস্তবায়নের গতি ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
-
জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি):
প্রথম এনডিসিতে বাংলাদেশ শর্তসাপেক্ষে ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমন ৬.৭৩% এবং শর্তহীনভাবে ৫.১০% কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পরবর্তীতে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও তা কতটুকু সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন ও নীতি:
বায়ু দূষণ (বিশেষ করে ইটভাটা) ও প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন ও নীতিমালা থাকলেও প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে। শিল্প বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন ও চালু রাখার বাধ্যবাধকতা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের আদেশ কার্যকর করা যায়নি।
চ্যালেঞ্জসমূহ:
-
সীমিত সম্পদ ও অর্থায়ন: জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দেশীয়ভাবে অসম্ভব। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়ন (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড - জিসিএফ) সহজলভ্য ও পর্যাপ্ত নয়।
-
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা: একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ঘাটতি এবং দুর্নীতি নীতি বাস্তবায়নের পথে বড় অন্তরায়।
-
সচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততার অভাব: পরিবেশ সংরক্ষণে ব্যক্তি ও সম্প্রদায় পর্যায়ে সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ এখনও অপর্যাপ্ত।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য বাংলাদেশের জন্য একটি জরুরি অ্যাকশন অ্যাজেন্ডা। জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের দ্বৈত অভিঘাত মোকাবিলা এবং এসডিজি অর্জনের জন্য প্রয়োজন:
ভূমি পুনরুদ্ধার (ম্যানগ্রোভ সৃজন, সবুজ বেষ্টনী), খরা সহিষ্ণু কৃষি, জল সংরক্ষণ ও পুনঃব্যবহার, এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক অভিযোজন পরিকল্পনা (সিবিএ) জোরদার করাও জরুরি।
দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ:
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে ইটভাটার আধুনিকীকরণ বাধ্যতামূলককরণ, যানবাহনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা, নির্মাণ সাইটে ধুলা নিয়ন্ত্রণ।
পানি দূষণ রোধে শিল্প কারখানায় ইটিপি স্থাপন ও চালু রাখা নিশ্চিত করা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উপর কার্যকর নিষেধাজ্ঞা, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো ও পুনর্ব্যবহার শিল্পের উন্নয়ন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে জোরালো রূপান্তর করা অতীব জরুরি। কয়লাভিত্তিক প্রকল্প পরিত্যাগ করে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎসের দিকে দ্রুত উত্তরণ ঘটানো সময়ের দাবি।
শক্তিশালী শাসন ও প্রয়োগ:
পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের কঠোর প্রয়োগ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন নিশ্চিত করাও জরুরি।
উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা আদায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
সচেতনতা সৃষ্টি ও জনসম্পৃক্ততা:
পরিবেশ শিক্ষাকে শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা, গণসচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে পরিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস কেবল একটি প্রতীকী দিন নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য প্রকৃতির সাথে সমঝোতা করে টিকে থাকার এবং টেকসইভাবে উন্নীত হওয়ার পথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার দিন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের মারণ ছোবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য, সবুজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে এখনই সমন্বিত, দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। প্রকৃতির মরণচিৎকার উপেক্ষা করার মতো সুযোগ এখন আর নেই।
সানজানা