ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঈদুল আজহার কুরবানি, আত্মোৎসর্গের মহিমা ও ইতিহাসের রক্তিম পঙ্‌ক্তিমালা

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ৫ জুন ২০২৫; আপডেট: ১১:২৬, ৫ জুন ২০২৫

ঈদুল আজহার কুরবানি, আত্মোৎসর্গের মহিমা ও ইতিহাসের রক্তিম পঙ্‌ক্তিমালা

একটি ছুরির ডগায় গলে যায় পৃথিবীর সমস্ত অহংকার। রক্তস্রোতের প্রতিটি ধারে উচ্চারিত হয় আনুগত্যের শুদ্ধতম কবিতা। ঈদুল আজহার কুরবানি শুধুই একটি আনুষ্ঠানিক পশু জবাইয়ের নাম নয়, এটি এক মহাসত্যের মূর্ত প্রতীক, আত্মোৎসর্গের, ত্যাগের, নিরবিচার ভালোবাসার।

এই কুরবানি ইতিহাসের অতল গর্ভে যাত্রা করে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ঘরে, যেখানে আসমানের নির্দেশে পিতা তুলে ধরেছিলেন ছুরির ধার প্রিয়তম সন্তানের কাঁধে। কী অসীম দৃঢ়তা, কী নিঃস্বার্থ সমর্পণ! আর সেই ক্ষীণ হাসিতে—যেটি ফুটেছিল ইসমাঈল (আ.)-এর মুখে—ছিল সর্বোচ্চ আত্মবিসর্জনের অনুপম প্রতিচ্ছবি।

এমন এক মুহূর্ত, যা শব্দের সীমা পেরিয়ে মহাকাব্যে পরিণত হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেই আত্মত্যাগকে পরম সন্তুষ্টির সীলমোহর দিয়ে বলেছিলেন—
“আর আমরা তার পরিবর্তে এক মহান কুরবানির ব্যবস্থা করেছিলাম।” (সূরা সাফফাত: ১০৭)

কুরআনের এই ঘোষণায় কেবল একটি সময়ের ঘটনাই লিপিবদ্ধ হয়নি, রচিত হয়েছে চিরন্তন এক দর্শন—যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি হয় সকল হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে। ঈমান তখনই পূর্ণ হয়, যখন বান্দা আল্লাহর ইশারায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়।

আজকের ঈদুল আজহার কুরবানি সেই অতীতের প্রতিধ্বনি। একেকটি পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে আমরা যেন উচ্চারণ করি আত্মশুদ্ধির প্রতিজ্ঞা—আমার ভেতরের অহংকার, লোভ, হিংসা ও জড়বাদী প্রবৃত্তির কুরবানি।

কুরআন বলছে—
“আল্লাহর কাছে পৌঁছে না পশুর মাংস কিংবা রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ: ৩৭)

এ আয়াতে প্রকট হয় কুরবানির আধ্যাত্মিক রূপ। যে পশুটি জবেহ হয়, তা বাহ্যিক। কিন্তু যেটি প্রকৃত কুরবানি—তা আত্মার, তা হৃদয়ের; আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত আত্মনিবেদন।

এ কুরবানি ওয়াজিব সেই সমস্ত মুসলমানদের ওপর, যারা সামর্থ্যবান—নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুকিম (অর্থাৎ মুসাফির নয়)। হানাফি মাজহাব মতে, যার ওপর যাকাত ওয়াজিব, তার ওপরই কুরবানি ওয়াজিব।

নবী করিম (সা.) বলেন—
“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।” (ইবন মাজাহ: ৩১২৩)

এই হাদিস একটি ভয়াবহ বাস্তবতার দর্পণ। কারণ কুরবানি হলো ঈমানদারির নিঃশব্দ অথচ জ্বলন্ত ঘোষণা—আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রস্তুত সব কিছু বিসর্জনে।

এ কুরবানির শিক্ষা সামাজিকতাতেও বিস্তৃত। একটি পশুর তিন ভাগ—একটি নিজের, একটি আত্মীয়ের, আরেকটি গরিবের—আমাদের শেখায় বিভাজন নয়, বরং সংহতির ভাষা। এই অনুশীলন একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর, ভোগের নয়, বিলাবার আনন্দে উদ্বেল হওয়ার।

আধুনিক সময়ের ঝলমলে মোড়কে কুরবানির অন্তর্নিহিত ভাব যেন হারিয়ে না যায়। ব্র্যান্ডেড পশু, দামি দামী রেজিস্ট্রেশন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার লোকদেখানো ছবি কুরবানির আসল চেতনাকে ঢেকে না ফেলে। কারণ, আত্মার যে পশু কুরবানি না হয়, কেবল চামড়া-মাংসের মোড়কে তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হয় না।

এই দিনে আমরা যদি আত্মজিজ্ঞাসা করি—আমাদের জীবনে ইসমাঈলি আত্মসমর্পণ আছে কিনা, ইব্রাহিমি আনুগত্যের ছাপ আছে কিনা—তবে কুরবানি আমাদের জীবনে সত্যিকার অর্থে নেমে আসবে।

ঈদুল আজহা তাই কেবল একটি উৎসব নয়, এটি একটি আন্দোলন—আত্মসংশোধনের, আত্মনিয়ন্ত্রণের, আত্মত্যাগের। সমাজে নতুন করে উদিত হোক সেই আদর্শের সূর্য—যেখানে কুরবানি শুধু একটি ছুরি নয়, এক অভ্যন্তরীণ বিপ্লব।

এই বিপ্লবই হোক ঈদের সবচেয়ে বড় উপহার।

ঈদ মোবারক।

আঁখি

×