ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

স্মৃতিতে বাক্সবন্দী ঈদ আনন্দ

হাসান মাহমুদ শুভ, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর

প্রকাশিত: ১০:১৬, ৬ জুন ২০২৫

স্মৃতিতে বাক্সবন্দী ঈদ আনন্দ

ছবি: জনকণ্ঠ

ঈদুল আযহা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। ইয়াওমুন নাহর নামেও মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত। তবে আমাদের সমাজে ইহা ‘কুরবানির ঈদ’ নামেই বেশি পরিচিত। এ উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘ত্যাগ ও উৎসর্গ’ করা।  ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করার পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, দুম্বা ও উট আল্লাহর নামে কুরবানি করে থাকে। আমাদের ওপর যে কুরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল (আ.)- কে আল্লাহর রাহে কুরবানি দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমিয়্যাহ’ হিসাবে চালু হয়েছে। পবিত্র মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন আত্মত্যাগের যে নজির স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আযহা’ বা ‘কুরবানির ঈদ’। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের এক উজ্জ্বল ও প্রকৃষ্ট নমুনা এই কুরবানির মাধ্যমে ফুটে ওঠে।

এই কুরবানির ঈদকে ঘিরে রয়েছে ব্যক্তি বিশেষ নানান জীবন্ত স্মৃতি। যা আমাদের স্মৃতির আঙ্গিনায় বেঁচে রয় আজন্ম। বিশেষ করে, গরুর হাটে বাবার সাথে গিয়ে গরু কেনার স্মৃতিগুলো আমাদের ফিরিয়ে নেয় সেই সোনালী ও স্মৃতি গাঁথা দিনগুলোতে। বাবা, চাচা এবং মুরুব্বিদের সাথে গিয়ে গরুর হাটে এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করা, গরু দেখা, দাম কষাকষি করা। সে কী আনন্দের! সময় বদলেছে, বদলিয়েছে আনন্দের মাত্রা। সবকিছু যেন রসকষহীন কাঠখোট্টায় পরিণত হচ্ছে দিনদিন। পড়াশোনার সুবাদে বাসার বাহিরে প্রায় পাঁচ বছর। ঈদ আসলেই বাবা ফোন দিতে থাকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসার জন্য একসঙ্গে হাটে গিয়ে গরু দেখা। গরু পছন্দ না হলে তারপর অন্য হাটে যাওয়া। গরুর মালিকের সাথে দর কষাকষি করা সবকিছু যেন এক মহা উৎসব। সব অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা যায় না। 
আমাদের বাসা গ্রামে হওয়াতে এখানে বিভিন্ন জাতের গরু দেখা যেতো। বাবার দৃষ্টি থাকতো সবসময় বড় গরুর দিকে।

আগেরকার দিনে মানুষজন ঈদ কার্ড, ঈদের চাঁদ দেখা, ঈদের প্রস্তুতি, ঈদের সালামি, ঈদ যাত্রা, সবকিছুই যেন এখন সময়ের ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সেই চিরচেনা অমলিন সোনালী শৈশবে কাটানোর ঈদ উৎযাপন। খুব ছোটবেলায় বইতে পড়েছিলাম- ‘আজ ঈদ। দলে দলে লোকজন ঈদগাহে চলিল।’ কি যে খুশির দোলা দিয়ে যেত এই দুটো লাইন। আজও কথাগুলো মনের কোনে গেঁথে আছে। ঈদ এলেই আগে লাইন দুটো ভীষণ মনে পড়ে। সময় বদলেছে, সেই ঈদের আমেজ এখন আর নেই। তবু এখনো চোখের কোনে সেই খুশি মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে যায়। ঈদ কার্ড বিতরণ ছোটবেলায় এক বিশাল আনন্দের উপলক্ষ ছিল। কেউ কেউ দোকান থেকে  রেডিমেড ঈদ কার্ড  কিনে নিয়ে আসতো আবার বেশি বা হাতে নানান নকশায় ঈদ কার্ড তৈরি করে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন এর মাঝে বিতরণ করতো। সবকিছু কেমন যেন  পানসে হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সোনালী শৈশব। আমার বয়স বারো কিংবা তেরো হবে। তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। ঈদের বাকি আনুমানিক আট কিংবা দশ দিন। বাজারে ঈদের কেনাকাটার তোরজোর। আব্বু আমার জন্য একটা এক কালারের নিল শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট নিয়ে আসলেন রাতের দিকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সে কী আনন্দ! আম্মুর জন্য নতুন পোশাক নিয়ে আসছেন। আব্বু নিজের জন্য কিছুই কিনেননি। বাবারা এমনই হয়। কেউ না দেখার আগেই আমি নিল রঙের শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট লুকিয়ে রাখি। বাড়ির কাজিন রা অনেক জোরাজোরি করলেও তাদের দেখাই নি ঈদ শেষ হয়ে যাবে বলে!

এভাবে দিন যায়। ঈদের বাকি একদিন। চাঁদ রাতে শার্ট, প্যান্ট আলমারি থেকে নিয়ে বালিশের নিচে রাখি। ঈদের দিন সকালে দেখি শার্টে ভাজ পরে গেছে।  দেখতে খুবই বাজে লাগছে। সে কী কান্নাকাটি! বাসায় আয়রন মেশিন ছিলো না। তখন হঠাৎ মাথায় আসলো স্টিলের পাত্রে জলন্ত কয়লা নিয়ে কিছু একটা করা যাবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। মোটামুটি ঠিক হল।" প্রতিটা ঈদের এরকম বহু গল্প জড়িয়ে আছে। এসব চিত্র এখনকার জেনারেশনের মধ্যে দেখা যায় না। অতি আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষের গহ্বরে হারিয়ে সোনালী শৈশবের ঐতিহ্য।
এখনো ঈদ আসে। এখন আর নতুন পোশাকের প্রতি আগ্রহ নাই। তবুও কেনাকাটা হয়। কিন্তু সেই আগের মতো আনন্দটা আর নেই।

মুমু

×