ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ধ্বংসস্তূপে ইতিহাস: আর্টেমিসের মন্দির

মো. আতিকুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০১:২৩, ৫ জুন ২০২৫

ধ্বংসস্তূপে ইতিহাস: আর্টেমিসের মন্দির

ছ‌বি: সংগৃহীত

প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম, দেবী আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে নিবেদিত এক বিশাল গ্রিক মন্দির, যা এফেসাস (বর্তমান তুরস্কের সেলজুক শহরের কাছে) নগরীতে অবস্থিত ছিল। একসময় স্থাপত্যশৈলী ও ধর্মীয় গুরুত্বের এক অনন্য প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হলেও, কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে এই মন্দিরের জাঁকজমক ও প্রভাব।

আর্টেমিসের মন্দিরের ইতিহাস প্রোথিত ব্রোঞ্জ যুগে। প্রাথমিক কাঠামোটি খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে একটি বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালের দিকে লিডিয়ার রাজা ক্রোসাসের অর্থায়নে এটি নতুন করে নির্মিত হয়, যা এক অভূতপূর্ব স্থাপত্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। পুরো মন্দিরটি ছিল মার্বেল পাথরে নির্মিত, সুদৃশ্য খচিত স্তম্ভে ঘেরা। এটি কেবল একটি উপাসনালয় ছিল না, বরং শিল্প ও প্রকৌশলের এক দুর্দান্ত নিদর্শন।

তবে, এই মহিমান্বিত কাঠামোর ভাগ্য ছিল অস্থির। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ সালে হেরোস্ট্রাটাস নামের এক ব্যক্তি কুখ্যাতি অর্জনের আশায় মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু ইফেসাসবাসীরা হাল ছাড়েনি। তারা মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে, যা আগের তুলনায় আরও বৃহৎ ও অলঙ্কারিক ছিল। এই সংস্করণ প্রায় ৬০০ বছর টিকে ছিল, স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে সেটি ছিল সময়ের তুলনায় অত্যন্ত দৃঢ় ও ব্যতিক্রমধর্মী।

আর্টেমিসের মন্দির ছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা সমবেত হতেন। এটি ছিল শুধু উপাসনার স্থানই নয়, বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎসব ও সামাজিক আদান-প্রদানের কেন্দ্র। ইফেসাসের আর্টেমিস ছিলেন শুধু গ্রিক শিকারের দেবী নন, বরং স্থানীয়ভাবে এক উর্বরতার মাতৃদেবী রূপে পূজিত হতেন, যার বহুস্তনী প্রতিকৃতি সেই সংস্কৃতিরই প্রতিফলন।

প্রতি বছর এই মন্দির ঘিরে বসত বিশাল মেলা ও উৎসব, যেখানে সমগ্র আয়নীয় অঞ্চল থেকে মানুষ একত্রিত হতো। এই কেন্দ্রটি ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক সংযোগের মাধ্যমে এশিয়া মাইনরের বহু শহর-রাষ্ট্রকে একত্র করত, যার ফলে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল আন্তর্জাতিক মাত্রায়।

তবে ইতিহাসের পরিণতি ছিল অনিবার্য। ২৬৮ খ্রিস্টাব্দে গথদের আক্রমণে এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যের শেষ যুগে খ্রিস্টান শাসনের সময় পৌত্তলিক উপাসনাগার হিসেবে এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে মন্দিরের মার্বেল স্তম্ভ ও পাথর স্থানীয় নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে, যা তার অবশিষ্ট গৌরবকে মুছে দেয়। বহু শতাব্দী এর প্রকৃত অবস্থান অনির্ধারিত ছিল, যতক্ষণ না ১৮৬৯ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ জন টার্টল উড এর ধ্বংসাবশেষ পুনরাবিষ্কার করেন।

আজ আর্টেমিসের মন্দির আর তার আদি রূপে বিদ্যমান নেই। একাকী দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্তম্ভই সেই প্রাচীন বৈভবের নিঃশব্দ সাক্ষী। তবু এর ইতিহাস রয়ে গেছে বিশ্ব ঐতিহ্যের পাতায়, যা আজও মানুষকে প্রাচীন সভ্যতা, বিশ্বাস, আর শিল্পের সম্ভ্রমে মোহিত করে তোলে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও এই মন্দির আজ এক জীবন্ত প্রতীক— উত্থান ও পতনের, বিস্ময় ও বিস্মৃতির।

এম.কে.

×