ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জামদানি: বাংলার তাঁতের জাদু, বিশ্ব ঐতিহ্যের গর্ব

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ০২:১৩, ৪ জুন ২০২৫

জামদানি: বাংলার তাঁতের জাদু, বিশ্ব ঐতিহ্যের গর্ব

ছবি: সংগৃহীত

শুধু একটি শাড়ি নয়, ‘জামদানি’ হলো বাঙালির শিল্প, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সূক্ষ্ম বুনন, মনোমুগ্ধকর নকশা ও কারিগরের নিপুণতায় তৈরি জামদানি শাড়ি আজ বিশ্ব-দরবারে স্বীকৃত এক বাঙালি ঐতিহ্য।


উৎপত্তি ও ইতিহাস

জামদানি শাড়ির শিকড় প্রাচীন বাংলায়। খ্রিষ্টপূর্ব যুগ থেকেই এ অঞ্চলে সূক্ষ্ম তুলা বস্ত্র বোনা হতো। কিন্তু ‘জামদানি’ শব্দটির প্রচলন মূলত মোগল আমলে, পারস্য শব্দ ‘জাম’ (ফুল) ও ‘দানি’ (বুনন) থেকে।

জামদানির স্বর্ণযুগ ছিল ১৬ থেকে ১৮ শতক। সে সময় ঢাকার তাঁতিরা অসাধারণ হাতে বুনতেন এই শাড়ি—যার প্রধান কেন্দ্র ছিল সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকা।

ইংরেজ উপনিবেশের সময় শিল্পটি ধ্বংসের মুখে পড়ে। তবু কিছু পরিবার প্রজন্ম ধরে এই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে।


শিল্প ও নকশার বাহার

প্রতিটি জামদানি শাড়িই হাতে বোনা এবং সময়সাপেক্ষ। এক একটি শাড়ি বুনতে লাগে ১৫ দিন থেকে ৬ মাস পর্যন্ত, নকশার জটিলতার ওপর নির্ভর করে।

জনপ্রিয় নকশাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

1.কলকা (ম্যাঙ্গো মোটিফ)

2.আঁখি (চোখ আকৃতি)

3.জিগজ্যাগ

4.তেরপাড়

5.চিত্রপদ্ম ও জালি নকশা


শুভ্র কাপড়ে রঙিন সুতোয় এই নকশাগুলো তৈরি হয়, যা জামদানিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।


তাঁতিদের গল্প: ঐতিহ্যের পাহারাদার

রূপগঞ্জ, বাউলিয়া, বালু নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে এখনো শত শত তাঁতি পরিবার জামদানি বুননে নিয়োজিত। তাঁরা জানান, "এই জামদানি আমাদের বাপ-দাদার শিল্প। লাভ কম হলেও বুনে যাই মনের আনন্দে।"

তাঁতিদের দাবি, সরকার যদি আরও সহযোগিতা করে—বিশ্ববাজারে জামদানির স্থান আরও সুদৃঢ় হবে।


বিশ্ব স্বীকৃতি ও জিআই ট্যাগ

২০১৩ সালে ইউনেস্কো জামদানিকে “ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ” হিসেবে ঘোষণা করে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ জামদানির জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) ট্যাগ পায়, যা এই শিল্পকে এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়।


জামদানি মেলা: উৎসব ঐতিহ্যের

প্রতি বছর রূপগঞ্জে জামদানি পল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় জামদানি উৎসব, যেখানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রেতারা শাড়ি কিনতে ভিড় করেন। এছাড়া সরকার উদ্যোগ নিয়েছে জামদানি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার, যা তরুণ প্রজন্মকে এই শিল্পের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।


সংকট ও সম্ভাবনা

বর্তমানে চীনা কৃত্রিম জামদানির হুমকিতে পড়েছে দেশীয় তাঁতিরা। তরুণদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় এই শিল্প ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। তবে ডিজিটাল মার্কেটিং, ডিজাইনে বৈচিত্র্য এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা—এই তিনে ভবিষ্যতে জামদানি হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের টেক্সটাইল ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।

 

জামদানি শুধু কাপড় নয়, এটি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা মানে আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে রক্ষা করা। আজ প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ, যাতে জামদানি হয়ে ওঠে আগামী দিনের ‘বাঙালির ব্র্যান্ড’।
 

Mily

×