
ছবি: সংগৃহীত
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে তামাকজাত পণ্যের উপর আবারও কর বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপ জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি ইতিবাচক বার্তা বটে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই কর বৃদ্ধির বাস্তব প্রভাব কী? তামাকপণ্যের ব্যবহার কি সত্যিই কমছে, নাকি এর আড়ালে অন্য বাস্তবতা আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে? কর বাড়লেও কেন কমছে না ব্যবহার?
বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যে কর বাড়ানোর ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রায় প্রতি বছরই বাজেটে সিগারেট, বিড়ি ও অন্যান্য ধোঁয়াযুক্ত পণ্যের উপর মূল্য সংযোজন কর (VAT), সম্পূরক শুল্ক (Supplementary Duty) বা উৎপাদন পর্যায়ে শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়। এবারের বাজেটেও একই ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবু বাংলাদেশে ধূমপানের ব্যবহার কমছে না। বরং তরুণদের মাঝে এক ধরনের 'ফ্যাশন' হিসেবে সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের একজন নিয়মিতভাবে ধূমপান করেন। অনেক নারীও চুপিসারে এই অভ্যাসে যুক্ত হচ্ছেন। তরুণদের মাঝেও উদ্বেগজনক হারে সিগারেট ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে।
আড়ালে কাজ করছে চতুর বিপণন কৌশল:
সরকারি কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাস্তবে কার্যকর হতে গেলে বাজারে তামাকপণ্যের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং বিজ্ঞাপন ও বিপণন পুরোপুরি বন্ধ করা জরুরি। অথচ বাস্তবতা হলো—তামাক কোম্পানিগুলো কৌশলে আড়ালের বিপণন চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
সিগারেটের ফাঁকি দেওয়া দাম:
কর বাড়ার পরেও নিম্নমানের সিগারেট ব্র্যান্ডগুলোর দাম খুব একটা বাড়ে না। কারণ এসব কোম্পানি কর ফাঁকি দেয় অথবা উৎপাদনের তথ্য গোপন করে। বাজারে মাত্র ৫-৭ টাকায় একটি সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে এখনও।
ইভেন্ট স্পনসরশিপ ও ক্লাব মার্কেটিং:
শহুরে তরুণদের টার্গেট করে মিউজিক ইভেন্ট, র্যাপ নাইট বা আর্ট ফেস্টিভ্যালে তামাক কোম্পানির ছদ্মবেশী প্রচার চলে। নাম হয় "Vibe Night" বা "Freedom Fest", কিন্তু স্পনসর থাকে কোনো তামাক ব্র্যান্ড।
ইনফ্লুয়েন্সার ব্যবহারে প্রচার:
সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণ তারকারা সিগারেট হাতে ছবি দেন, যেটি সরাসরি বিজ্ঞাপন না হলেও এক ধরনের বিপণনই। কর বাড়লেও এই মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা থেকে তরুণদের বিরত রাখা যাচ্ছে না। সরকারি পদক্ষেপে ফাঁক ফোকর কোথায়? সরকারের করনীতি উদ্দেশ্যপ্রসূ হলেও কয়েকটি বাস্তব দুর্বলতা রয়েছে.
ট্যাক্স স্ট্রাকচারে ফাঁক:
কমদামি এবং নিম্নমানের সিগারেট ব্র্যান্ডগুলোর ক্ষেত্রে কর কাঠামো এখনও দুর্বল, যা আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটকে টিকিয়ে রাখে। কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাব: ডিজিটাল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ও ইভেন্ট মার্কেটিংয়ের ওপর কার্যকর নজরদারি নেই। ফলে আড়ালের বিজ্ঞাপন অনায়াসে চলতে থাকে।
তামাক কোম্পানির CSR প্রভাব:
কিছু তামাক কোম্পানি শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পরিবেশ নিয়ে CSR (Corporate Social Responsibility) প্রকল্প চালিয়ে নিজেদের সামাজিক ইমেজ গড়ে তুলছে, যাতে সরকার বা সমাজ তাঁদের বিপণন কার্যক্রমকে সহজে প্রশ্ন না তোলে।
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী অন্তত একবার সিগারেট ট্রাই করেছে এবং তাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নিয়মিত ব্যবহারকারী। তারা এটিকে “স্ট্রেস কমানোর মাধ্যম”, “স্মার্ট হওয়ার প্রতীক” বা “বন্ধুদের সঙ্গে মানিয়ে চলার অংশ” হিসেবে দেখে। এই মনোভাব বদলাতে হলে শুধুমাত্র কর বাড়ানো যথেষ্ট নয়, দরকার চেতনাভিত্তিক ও ডিজিটাল যুগোপযোগী সামাজিক হস্তক্ষেপ।
কর বাড়ানো তামাক নিয়ন্ত্রণের একটি মাত্র অংশ। এটি কাজ করবে তখনই, যখন কর বৃদ্ধির প্রভাব বাজারে বাস্তবিকভাবে পড়বে, বিশেষ করে কমদামি ব্র্যান্ডে। ডিজিটাল ও সামাজিক মিডিয়ায় প্রচার কার্যকরভাবে বন্ধ করা যাবে। তরুণদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা হবে ইনফ্লুয়েন্সার ও জনপ্রিয় মাধ্যমের মাধ্যমে।
নীতিনির্ধারকদের জন্য কিছু বাস্তবিক সুপারিশ: তামাকবিরোধী আইন শুধু কাগজে নয়, রিয়েল টাইমে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউব পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তরুণদের আদর্শ হিসেবে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের মাধ্যমে তামাকবিরোধী বার্তা ছড়ানো। তামাক কোম্পানির সামাজিক প্রকল্পগুলোকে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে অভিযান বাড়িয়ে ফাঁকিবাজ কোম্পানিকে আইনের আওতায় আনা দরকার।
কর বাড়ালেই কাজ হবে না, বদলাতে হবে কৌশল:
প্রতিবছর বাজেটে কর বাড়ানো একটি সুস্পষ্ট বার্তা, তামাক প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের দেখতে হবে, এই কর কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেইসঙ্গে তরুণদের মনস্তত্ত্ব, বাজার কৌশল, আড়ালের প্রচারণা ও সামাজিক বাস্তবতা সব কিছুর সমন্বিত বিশ্লেষণ দরকার।
সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট তামাক প্রতিরোধ কৌশল নিতে হবে। যা শুধু কর বাড়ানো নয়, বরং সমাজ-সচেতনতা, প্রযুক্তি এবং তরুণদের নিয়ে তৈরি একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ।
লেখকঃ বিভাগীয় প্রধান, মার্কেটিং বিভাগ,
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ফারুক