
আমাদের মস্তিষ্কের এক বিচিত্র ক্ষমতা রয়েছে – ভালো স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখা এবং খারাপ স্মৃতিগুলোকে সহজে ভুলতে না পারা। অনেক সময় দেখা যায়, জীবনের সব আনন্দময় মুহূর্তগুলো সময়ের স্রোতে ফিকে হয়ে এলেও, কষ্টকর বা বেদনাদায়ক স্মৃতিগুলো আমাদের মনে গেঁথে থাকে গভীরভাবে। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ডা. মুনমুন জাহান, একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক, এই জটিল প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেছেন।
ডা. মুনমুন জাহান জানান, আমাদের মস্তিষ্ক খারাপ বা বেদনাদায়ক স্মৃতিগুলোকে এক বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। এর কারণ হলো, মস্তিষ্ক যেকোনো বিপদ বা নেতিবাচক অভিজ্ঞতাকে ভবিষ্যতের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে সংরক্ষণ করে। এটি আমাদের টিকে থাকার একটি সহজাত প্রক্রিয়া। যেমন, যদি কোনো ব্যক্তি একবার আগুন ছুঁয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলে, তবে সেই অভিজ্ঞতাটি তার মনে এত শক্তভাবে গেঁথে যায় যে পরবর্তীতে সে আগুন থেকে দূরে থাকে। এটি এক ধরনের আত্মরক্ষার কৌশল, যা খারাপ স্মৃতিকে বেশিদিন মনে রাখতে সাহায্য করে।
কিছু কারণ যা খারাপ স্মৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করে:
-
মস্তিষ্কের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: আমাদের মস্তিষ্ক চায় আমরা যেন একই ভুল বা একই ধরনের বিপদের সম্মুখীন না হই। তাই এটি নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোকে একটি সতর্কবার্তা হিসেবে মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করে। এর ফলে, যখন আমরা একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, তখন মস্তিষ্ক দ্রুত সেই স্মৃতিটি মনে করিয়ে দেয়, যাতে আমরা সতর্ক হতে পারি।
-
আবেগিক তীব্রতা: খারাপ স্মৃতিগুলো প্রায়শই তীব্র আবেগ, যেমন – ভয়, দুঃখ, ক্রোধ বা হতাশার সাথে জড়িত থাকে। আবেগিক দিক থেকে শক্তিশালী ঘটনাগুলো আমাদের মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমে (বিশেষ করে অ্যামিগডালাতে) আরও ভালোভাবে এনকোড হয়, যা স্মৃতির স্থায়িত্ব বাড়ায়। ভালো স্মৃতিতেও আবেগ জড়িত থাকে, তবে খারাপ স্মৃতির সাথে যুক্ত আবেগ প্রায়শই আরও প্রবল এবং স্থায়ী হয়।
-
পুনরাবৃত্তি ও চিন্তা: আমরা যখন কোনো খারাপ স্মৃতিকে বারবার মনে করি বা তা নিয়ে চিন্তা করি, তখন মস্তিষ্কের সেই স্মৃতি সম্পর্কিত নিউরাল পাথওয়েগুলো আরও শক্তিশালী হয়। এটি এক ধরনের স্মৃতির অনুশীলন, যা অনিচ্ছাকৃতভাবে স্মৃতিটিকে আরও পোক্ত করে তোলে। বন্ধুদের সাথে আলোচনা, ডায়েরি লেখা বা এমনকি রাতের বেলায় অনিদ্রা নিয়ে চিন্তা করাও এই পুনরাবৃত্তির কারণ হতে পারে।
-
মানসিক চাপ ও ট্রমা: কোনো ট্রমাটিক ঘটনা (যেমন দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের মৃত্যু, বা হিংসাত্মক অভিজ্ঞতা) মস্তিষ্কে গভীর প্রভাব ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে শরীর স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে, যা মস্তিষ্কের স্মৃতি প্রক্রিয়াকরণকে প্রভাবিত করে এবং স্মৃতিগুলোকে আরও স্থায়ী করে তোলে। পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে ব্যক্তি বারবার সেই খারাপ ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক অনুভব করে।
-
অপর্যাপ্ত সমাধান: অনেক সময় আমরা খারাপ ঘটনাগুলোকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়া করতে পারি না বা সেগুলোর একটি সমাধান খুঁজে বের করতে পারি না। যখন একটি স্মৃতি অমীমাংসিত থাকে, তখন মস্তিষ্ক এটিকে 'সম্পূর্ণ' করার জন্য বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকে। এটি এক ধরনের মানসিক চক্র, যা স্মৃতিকে ভুলতে দেয় না।
মুক্তি পাওয়ার উপায়:
ডা. মুনমুন জাহান পরামর্শ দেন যে, খারাপ স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমে সেগুলোকে গ্রহণ করা জরুরি। আবেগগুলোকে দমন না করে প্রকাশ করা উচিত। প্রয়োজনে একজন পেশাদার কাউন্সিলর বা থেরাপিস্টের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। মাইন্ডফুলনেস চর্চা, ইতিবাচক চিন্তা এবং জীবনের বর্তমান মুহূর্তের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করাও খারাপ স্মৃতির প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। সময় এবং সঠিক মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে খারাপ স্মৃতির মোকাবেলা করা সম্ভব।
সাব্বির