
ছবি: সংগৃহীত
মানুষের সভ্যতা যতই এগিয়েছে, প্রকৃতি যেন ততটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নগরায়ন, বন উজাড়, শিল্পায়ন, এবং ভোগবাদী চিন্তার কারণে আমরা প্রকৃতিকে যেমনভাবে অবহেলা করেছি, আজ তার ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া আমরা নিজেরাই ভোগ করছি দূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা, খরা, প্লাবন, ভূমিকম্প আর ঘূর্ণিঝড়ের রূপে। এই সংকটে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত: প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, প্রকৃতির পুনর্জাগরণ চাই। বিশ্ব পরিবেশ দিবস সেই প্রতিজ্ঞাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বর্তমানে পৃথিবী এক গভীর পরিবেশ সংকটের মধ্যে রয়েছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি অনুযায়ী, প্রতি মিনিটে গড়ে ২০ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণের কারণে অকাল মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে এসব প্রভাব আরও ভয়ংকর। ঢাকায় বায়ুদূষণ সূচক (AQI) নিয়মিতই ২০০-এর ওপর থাকে, যা “অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর” হিসেবে চিহ্নিত।
"প্রকৃতির প্রতিশোধ" বলতে আমরা বুঝি, মানবিক অমানবিকতা ও অগ্রহণযোগ্য আচরণের জবাবে প্রকৃতির তীব্র প্রতিক্রিয়া যা ঘূর্ণিঝড়, তাপদাহ, বন্যা, মহামারির মতো দুর্যোগে প্রকাশ পায়। পক্ষান্তরে, "প্রকৃতির পুনর্জাগরণ" হলো সচেতন মানবিক চেতনার ফল, যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে তোলে, বনায়ন করে, দূষণ কমায়, এবং টেকসই জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার প্রথম দশটি দেশের একটি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা ও ঘূর্ণিঝড়, উত্তরাঞ্চলে খরা ও মরুকরণ, এবং শহরাঞ্চলে দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য চরমভাবে হুমকির মুখে। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ২০–২৫% জমি মরুকরণের দিকে ধাবিত হয় (BARI, 2022)। ঢাকায় মাথাপিছু গাছের সংখ্যা ০.৩, যেখানে ন্যূনতম দরকার ৪। রাজধানীর প্লাস্টিক বর্জ্যের ৪০% নদীতে পড়ে। এই পরিসংখ্যান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে পুনর্জাগরণ নয়, আমরা যেন প্রতিশোধকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
পরিবেশ পুনর্জাগরণের জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে: গাছ লাগানো ও বন সংরক্ষণ: "একটি গাছ একটি প্রাণ" এই নীতিতে জাতীয়ভাবে বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো। পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা: ঢাকাসহ বড় শহরে গ্রীন জোন, খাল-পুকুর সংরক্ষণ ও ছাদ বাগানের উৎসাহ। পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার: প্লাস্টিকের বদলে কাপড়, কাগজ ও জৈব উপকরণ ব্যবহার পরিবেশ শিক্ষার প্রসার: স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বাধ্যতামূলক পরিবেশ শিক্ষা নাগরিক সচেতনতা: "গ্লোবালি চিন্তা করো, স্থানীয়ভাবে কাজ করো" এই নীতিতে ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক পরিবর্তন।
প্রকৃতি আমাদের শত্রু নয়, বন্ধু। আমরা প্রকৃতির যতটা ক্ষতি করেছি, এখন সময় তার ক্ষত সারিয়ে তোলার। আমাদের প্রয়োজন প্রতিশোধ নয়, প্রকৃতিকে ভালোবেসে তার পুনর্জাগরণ। বিশ্ব পরিবেশ দিবস আমাদের সুযোগ করে দেয় আত্মসমালোচনার, পরিবর্তনের, ও এক নতুন পৃথিবী গড়ার। সেই পৃথিবীতে প্রকৃতি এবং মানুষ সহাবস্থানে থাকবে ভয় নয়, ভালোবাসা নিয়ে।
লেখক: সুন্দরবন গবেষক (ইমেইল: [email protected])
এম.কে.