
ছবি: সংগৃহীত
প্রতি বছর ৫ জুন পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস—একটি প্রতীকী দিন, যেখানে শুধু বক্তৃতা-সেমিনারে সীমাবদ্ধ না থেকে আমাদের বাস্তব জীবনের প্রতিফলনে দেখার সময় এসেছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য “Only One Earth” বা “শুধু একটাই পৃথিবী”—একটি সরল বাক্য হলেও এতে লুকিয়ে আছে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার মূল বার্তা।
আজকের পৃথিবী কীভাবে নিজের ভার বহন করছে—তা বোঝা কঠিন নয়। বর্ষা আসলেই জলাবদ্ধতা, শীতের সকালে কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়া বায়ু, গ্রীষ্মে তীব্র দাবদাহ, অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানি কিংবা নদীভাঙনের আর্তনাদ—সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন প্রতিনিয়ত আমাদের জানান দিচ্ছে যে তার সহ্যক্ষমতা শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে।
আমরা সবাই জানি, সৌরজগতের নয়টি গ্রহের মধ্যে পৃথিবীই একমাত্র বাসযোগ্য। এর অনুকূল তাপমাত্রা, বাতাস, জলবায়ু এবং প্রাণবৈচিত্র্য কোনো কৃত্রিম প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি নয়। কিন্তু এই প্রকৃতি আমরা প্রতিদিন ধ্বংস করছি নিজেদের সুবিধার্থে। মানুষের লোভ, অবিমৃশ্যকারিতা, আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে প্রকৃতির ওপর চলছে এক অনির্বাণ আগ্রাসন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইতিমধ্যেই গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের বরফ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, হিমালয় পর্বতমালায় কমছে তুষারপাত। বাংলাদেশে তাপমাত্রার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষিতে—ধানের ফলন হ্রাস, আমন মৌসুমে খরা ও বন্যা উভয়ই দেখা যাচ্ছে, লবণাক্ততা ঢুকে পড়েছে মাটির গভীরে।
এই চিত্র শুধু বাংলাদেশের নয়—গোটা বিশ্বের। আর তাই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন—এই শতাব্দীর মধ্যেই যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, তাহলে পরিস্থিতি হবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় কেবল দূরবর্তী কোনো ভাবনার বিষয় নয়—এটা এখন ঘরের সমস্যা। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীতে বায়ু মান সূচক (AQI) প্রায়ই বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করে। খাল ও নদী দখল, বর্জ্য ফেলা, শব্দদূষণ, নির্বিচারে গাছ কাটা—এসব যেন নিত্যদিনের বাস্তবতা।
শহরের বাইরেও সংকট কম নয়। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় অনাবৃষ্টি ও খরার প্রভাবে চাষাবাদ হুমকির মুখে। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা ধান ও মিষ্টি পানির মাছের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মাঝারি শহরগুলোর অপরিকল্পিত সম্প্রসারণও আজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠছে।
জাতিসংঘ ২০২২ সালেই বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রেক্ষাপটে তিনটি মারাত্মক সংকট চিহ্নিত করেছিল, যা এখন আরও প্রকট হয়েছে:
জলবায়ু পরিবর্তন:
পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে এবং তার প্রভাব পড়ছে ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি, দাবানল—এইসব চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাতে।
জীববৈচিত্র্য হ্রাস:
বিশ্বে প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে। এই হার চলমান থাকলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য চিরতরে নষ্ট হবে।
দূষণ ও বর্জ্য:
বিশ্বজুড়ে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। একদিকে শিল্পবর্জ্য, অন্যদিকে প্লাস্টিক—দুই মিলে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে দ্রুতগতিতে।
আমাদের করণীয়: একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে
১. বনায়ন ও সবুজায়ন:
নগর-গ্রাম সর্বত্র গাছ লাগাতে হবে। ‘একজন, একটি গাছ’ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরিবার পর্যন্ত।
২. পরিবেশবান্ধব যাতায়াত:
গণপরিবহন, সাইকেল, হেঁটে চলার অভ্যাস বাড়াতে হবে। ইলেকট্রিক যানবাহন ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা দেওয়া উচিত।
৩. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা:
বাসা, দোকান, কলকারখানায় বর্জ্য আলাদা করে ফেলা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. জলাধার রক্ষা:
খাল-বিল-নদী ভরাট বন্ধ করতে হবে আইন প্রয়োগ করে। পানি ব্যবহারে কৃচ্ছতা অনুশীলন জরুরি।
৫. পরিবেশ শিক্ষার সংযোজন:
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবভিত্তিক পরিবেশ শিক্ষা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণভিত্তিক কোর্স চালু করতে হবে।
৬. জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ:
বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণ ও অবৈধ শিকার ঠেকাতে জনসচেতনতা ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা দরকার।
আমাদের বর্জনীয় কিছু আচরণ
১. প্লাস্টিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার:
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যে নির্ভরতা কমাতে হবে। বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হোক পাট বা বায়োডিগ্রেডেবল পণ্য।
২. অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ও পানির অপচয়:
অপ্রয়োজনীয় লাইট, ফ্যান চালু রাখার মতো অভ্যাস আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা জরুরি।
৩. জঙ্গল ও পাহাড় কাটা:
পর্যটন বা নির্মাণের নামে নির্বিচারে পাহাড় কাটা ও গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ে।
৪. শব্দ ও আলো দূষণ:
অতিরিক্ত হর্ন, লাউডস্পিকার, বিয়ের অনুষ্ঠান বা রাজনৈতিক সভায় অসহনীয় শব্দ দূষণ রোধে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
৫. দায়িত্ব এড়ানো মানসিকতা:
“আমি করলে কী হবে, সবাই তো করে”—এই মানসিকতা পরিবেশ ধ্বংসে অন্যতম কারণ। পরিবর্তন শুরু হোক নিজের ঘর থেকে। পৃথিবী আমাদের দিয়েছে সব—জল, বাতাস, খাদ্য, আবাস। বিনিময়ে আমরা তাকে কী দিয়েছি? দূষণ, ধ্বংস আর অবহেলা।
আজ যদি আমরা না বদলাই, তাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে দায়ী থাকব আমরা সবাই।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস তাই শুধুই একদিনের প্রতীক নয়—এটি একটি স্মরণপত্র, একটি দায়বদ্ধতার দিন, একটি শপথ নেওয়ার দিন।
আসুন, আমরা সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিই—অতীতের ভুল শুধরে ভবিষ্যতের জন্য গড়ি একটি সবুজ, পরিচ্ছন্ন, টেকসই পৃথিবী। কারণ সত্যিই, আমাদের শুধু একটাই পৃথিবী। আর একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
লেখক: সোহাইল আহমেদ
কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক