
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে, যেখানে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, পরিমাপ এবং প্রতিবেদন দিন দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। উপগ্রহ-ভিত্তিক ভূ-পর্যবেক্ষণ (আর্থ অবজারভেশন বা সংক্ষেপে (BI/EO) কেবল একটি প্রযুক্তিগত উপকরণ নয়, বরং প্রতিটি দেশের জন্য একটি কৌশলগত প্রয়োজন। চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি এবং দ্রুত পরিবেশগত প্রভাবের প্রেক্ষাপটে, উপগ্রহ ভিত্তিক ভূ-পর্যবেক্ষণ তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি কার্যকরী এবং সাশ্রয়ী মাধ্যম সরবরাহ করে।
বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভূমি ক্ষয়, পানির সংকট, বন উজাড় এবং জলবায়ু দুর্যোগের সম্মিলিত চাপে জর্জরিত। যদিও এসডিজি অর্জনে প্রচলিত তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি অপরিহার্য, এগুলো দ্রুত, নির্ভরযোগ্য এবং ব্যাপকভিত্তিক (স্কেলযোগ্য) বিশ্লেষণ প্রদানে পুরোপুরি সক্ষম নয়, বিশেষ করে দুর্গম বা দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে অথবা অতীতের পরিবর্তন পর্যালোচনার ক্ষেত্রে। উপগ্রহভিত্তিক ভূ-পর্যবেক্ষণ চিত্র এ ঘাটতি পূরণ করে। কারণ এটি সময়োপযোগী, মানসম্মত এবং ধারাবাহিকভাবে বর্তমান ও অতীতের উপাত্ত সরবরাহ করে, যা এসডিজির অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য অপরিহার্য। ভূ-পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ বিষয়ক কমিটির (কমিটি অন আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইটস বা সিইওএস) মতে, উপগ্রহভিত্তিক ভূ-পর্যবেক্ষণ প্রায় ৩০টি এসডিজি সূচকে সরাসরি সহায়তা করতে পারে এবং প্রায় ৪০টি লক্ষ্যের বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত এসডিজি ২ (ক্ষুধামুক্তি), এসডিজি ৬ (বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন), এসডিজি ১১ (টেকসই নগর ও জনপদ), এসডিজি ১৩ (জলবায়ু কার্যক্রম) এবং এসডিজি ১৫ (স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা)- এই লক্ষ্যগুলো বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের একাধিক সরকারি সংস্থা ইতোমধ্যে ভূ-পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তিকে তাদের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং নিয়মিত ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশ বন বিভাগ ভূমি আচ্ছাদন ও বন পর্যবেক্ষণে উপগ্রহ চিত্র ব্যবহার করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সেন্টিনেল-১ এবং সেন্টিনেল-২ উপগ্রহের তথ্য ব্যবহার করে ফসলের স্বাস্থ্য ও ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা পূর্বাভাস এবং প্লাবিত এলাকার ঝুঁকি নিরূপণে ভূ-পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ অবকাঠামো পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণে ভূ-পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন কৌশল (টুল) ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভূ-পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্য-উপাত্ত তৈরি ও যাচাই করছে। তবে এই সকল অগ্রগতি সত্ত্বেও ভূ-পর্যবেক্ষণের ব্যবহার এখনো বিচ্ছিন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক উপগ্রহ চিত্রের ওপর নির্ভরশীল। অথচ ল্যান্ডস্যাট ও কোপারনিকাসের মতো বৈশ্বিক উদ্যোগের মাধ্যমে বহু বছর ধরে বিনামূল্যে সহজলভ্য তথ্যভাণ্ডার (ডেটাসেট) এক্ষেত্রে সাশ্রয়ী ও কার্যকর বিকল্প হতে পারে।
ভূ-পর্যবেক্ষণের এই যুগান্তকারী সম্ভাবনাকে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে হলে জাতীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থায় এটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে এসডিজি সূচক পর্যবেক্ষণে ভূ-পর্যবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি), ইসিমদের এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। গুগল আর্থ ইঞ্জিনের মতো ক্লাউড-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলো অবাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত, যা সীমিত সম্পদের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ব্যয়বহুল কম্পিউটার অবকাঠামো ছাড়াই বিশাল তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করার সুযোগ দেয়।
২০৩০ এজেন্ডার মূলনীতি অনুযায়ী, তথ্য হতে হবে সময়োপযোগী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। ভূ-পর্যবেক্ষণ এই দায়বদ্ধতা পূরণে সহায়ক, যার মাধ্যমে “কাউকে পেছনে ফেলে নয়” নীতিটির সফল বাস্তবায়ন সম্ভব। এটি শহরের প্রান্তবর্তী অঞ্চল, চরাঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা এবং হাওড়াঞ্চলসহ দেশজুড়ে স্থানিক বাস্তবতা তুলে ধরতে সক্ষম, যা অনেক সময় প্রচলিত তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতির আওতার বাইরে থেকে যায়। সরকারি নীতিমালায় ভূ-পর্যবেক্ষণকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করার ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ভূ-স্থানিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্ব এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে ভূ-স্থানিক তথ্যভিত্তিক যাচাইকরণ ক্রমশ অপরিহার্য হয়ে উঠছে। এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তহবিল প্রাপ্তিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। নেপাল সরকার যেভাবে আন্তর্জাতিক তহবিল পেয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত, উপগ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথে সক্রিয়, এখন প্রয়োজন শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় ও সদিচ্ছা। ভূ-পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এসডিজি পরিচালিত হলে, বাংলাদেশ একটি অধিকতর সহনশীল, ন্যায়ভিত্তিক ও জ্ঞাননির্ভর ভবিষ্যতের দিকে মসৃণভাবে এগিয়ে যেতে পারবে।
লেখক : ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ইসিমোড, নেপাল
প্যানেল